Rene Descartes Biography In Bengali – রেনে দেকার্ত জীবনী

Rene Descartes Biography In Bengali - রেনে দেকার্ত জীবনী
Rene Descartes Biography In Bengali - রেনে দেকার্ত জীবনী

Rene Descartes Biography In Bengali – রেনে দেকার্ত জীবনী: আজ আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি মহান ব্যক্তিদের জীবনী সমগ্র। মহান ব্যক্তি আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা। তাঁদের জীবনের ক্ষুদ্রতম অংশগুলি আমাদের জন্য শিক্ষামূলক হতে পারে।

Rene Descartes Biography In Bengali – রেনে দেকার্ত জীবনী

বর্তমানে আমরা এই মহান ব্যক্তিদের ভুলতে বসেছি। যাঁরা যুগ যুগ ধরে তাদের কর্ম ও খ্যাতির মধ্য দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন এবং জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প ও সাহিত্যের জগতে এক অনন্য অবদান রেখেছেন এবং তাঁদের শ্রেষ্ঠ গুণাবলী, চরিত্র দ্বারা দেশ ও জাতির গৌরব বৃদ্ধি করেছেন। সেইসব মহান ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম ফরাসি দার্শনিক, গণিতজ্ঞ ও বিজ্ঞানী রেনে দেকার্ত (Rene Descartes) -এর সমগ্র জীবনী সম্পর্কে এখানে জানব।

রেনে দেকার্ত জীবনী – Rene Descartes Biography in Bengali

নামরেনে দেকার্ত
জন্ম31 মার্চ 1596
পিতাজান ব্রোশার
মাতা
জন্মস্থানলা হায়ে অ ত্যুরাইন, ফ্রান্স
জাতীয়তাফরাসি
পেশাফরাসি দার্শনিক, গণিতজ্ঞ ও বিজ্ঞানী
মৃত্যু11 ফেব্রুয়ারি 1650 (বয়স 53)

রেনে দেকার্ত কে ছিলেন? Who is Rene Descartes?

রেনে দেকার্ত ইউরোপের রেনেসাঁকে অবলম্বন করে খ্রিস্টীয় পনেরও ষোল শতকে যেসব তীক্ষ্ণধী মনীষীর আবির্ভাব হয়েছিল রেনে দেকার্ত ছিলেন এঁদের অন্যতম। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে কুসংস্কার আর অন্ধ বিশ্বাসের অন্ধকার থেকে সমাজকে মুক্ত করতে হলে সত্যের আলোয় জ্ঞানের পথ আলোকিত করতে হবে। সব সত্যই প্রকৃতির রাজ্যে রয়েছে সঙ্গুপ্ত। রহস্যের আবরণে আবৃত। রহস্যের আবরণ সরিয়েই সেই সত্যকে উদ্ধার করতে হবে। আর সত্য উদ্ধারের বা আবিষ্কারের একমাত্র পথ নিরন্তর গবেষণা।

দেকার্ত বিশ্বাস করতেন, একদিন নিজ প্রতিভা ও অনুসন্ধান বলে মানুষ প্রকৃতিকে জয় করতে সমর্থ হবে। সাধারণ রোগশোকের কারণ থেকে মহাকাশের ধূমকেতুর প্রকৃতি পর্যন্ত যেখানে যে সত্য রয়েছে তার সবই একদিন সন্ধানী মানুষের করায়ত্ত হবে।

ভবিষ্যতের সেই সম্ভাবনার স্বপ্ন নিয়েই প্রকৃতির গোপন সত্যকে আবিষ্কারের জন্য তিনি এমন এক পদ্ধতির কথা ভাবতেন যার প্রধান উপকরণ হবে অঙ্কশাস্ত্র।

রেনে দেকার্ত এর জন্ম: Rene Descartes’s Birthday

জ্ঞানতীর্থের নবীন অভিযাত্রী রেনে দেকার্তের জন্ম হয় ১৫৯৬ খ্রিঃ ৩১ শে মার্চ।

রেনে দেকার্ত এর পিতামাতা ও জন্মস্থান: Rene Descartes’s Parents And Birth Place

জন্মের পরে হাসপাতাল থেকে ঘরে আসার আগেই শিশু দেকার্ত মাতৃহারা হয়েছিলন।

মায়ের স্নেহ ও সতর্কতা নিয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে দ্রেকার্তকে ফিরিয়ে এনেছিলেন তাঁর বাবা। বাবার হাত ধরেই বড় হয়ে উঠেছিলেন তিনি। কিন্তু ছেলেবেলা থেকেই ছিলেন দুর্বল ও রুগ্ন।

ঘরে মা ছিল না, তাই অন্তহীন বিষণ্ণতা ছেলেবেলা থেকেই তাঁকে আচ্ছন্ন করে রাখত।

শিশুর চঞ্চলতা স্বতঃস্ফুর্ত বালউচ্ছ্বাস তার মধ্যে ছিল অনুপস্থিত। গভীর একাকীত্বের মধ্যে নিজেই নিজেকে নিয়ে মগ্ন থাকতেন।

মাঠে ঘাটে বনের ছায়ায় তাঁকে নিঃসঙ্গ অবস্থায় ঘুরে বেড়াতে, কখনো নিশ্চুপ বসে থাকতে দেখা যেত।

চারপাশের প্রকৃতির নানা দৃশ্যের বিচিত্র আয়োজনের মধ্যে মুগ্ধ বিস্ময়ে আত্মহারা হবার মত উপকরণের অভাব ছিল না। সব তিনি দেখতেন, শুনতেন, উপভোগ করতেন।

তার মধ্যেই প্রকৃতির অন্তগূঢ় সত্যের হাতছানি উপলব্ধি করতেন দেকার্ত। তিনি বুঝতে পারতেন এই বিপুল বিস্ময়ের উৎসের সন্ধান রয়েছে প্রকৃতিরই গর্ভে নিহীত।

রেনে দেকার্ত এর ছোটবেলা: Rene Descartes’s Childhood

কি করলে তার সন্ধান পাওয়া যেতে পারে নিরন্তর এই জিজ্ঞাসায় আলোড়িত হত তাঁর শিশুমন।

শরীর বরাবরই নানা ভোগে কষ্ট দেয়। নিবিষ্ট হয়ে অন্যদশটা ছেলের মত পড়াশোনা করবেন তার উপায় কি ? বাবাও পড়াশোনার চাপ বাড়িয়ে রুগ্ন ছেলের কষ্ট বাড়াতে চাইতেন না। তাই আট বছর বয়সের আগে লা ফ্লেচের জেসুইট স্কুলে ভর্তি হবার সুযোগ পাননি।

স্কুলের রেক্টর মা-হারা রুগ্ন বিষণ্ণ প্রকৃতির ছেলেটিকে সর্বদাই চোখে চোখে রাখতেন।

মাঝে মাঝে কাছে ডেকে আদর করে বসিয়ে মনীষীদের গল্প শোনান। কখনো অতীতের ইতিহাস ঘেঁটে মানুষের সভ্যতার রোমাঞ্চকর কাহিনী শোনান।

এসব শুনতে শুনতে এক অজানা জগতের স্বপ্নে দুলে উঠত বালক দেকার্তের মন। আনন্দে ভুলে যেতেন শরীরের দুর্বলতার কথা।

অল্পদিনের মধ্যে ধর্মপ্রাণ বৃদ্ধ রেক্টর বুঝতে পারেন ভবিষ্যতের উজ্জ্বল সম্ভাবনা নিয়ে জন্মেছে এই বিষণ্ণ দর্শন বালক।

রেনে দেকার্ত এর শিক্ষাজীবন: Rene Descartes’s Educational Life

তিনি যত্নের সঙ্গেই সুশিক্ষার ব্যবস্থা করেন দেকার্তের। সেই সঙ্গে ছাত্রের ভাঙ্গা স্বাস্থ্য গড়ে তোলার জন্যও সচেষ্ট হন। তার চেষ্টায় ও যত্নে হস্টেলের জীবনগুলো ভিন্ন স্বাদের হয়ে উঠল দেকার্তের কাছে।

অল্পদিনের মধ্যেই সাহিত্য ইতিহাস বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে সহপাঠীদের তুলনায় অনেক বেশি এগিয়ে দেকার্ত। যুক্তিবিজ্ঞান, নীতিবিদ্যা, আধিদৈবী বিদ্যা এসবের পাঠেও তিনি পিছিয়ে থাকেন না।

ধীরে ধীরে একসময় জ্যামিতি ও বীজগণিতের সঙ্গেও তাঁর পরিচয় হয়। গণিতের এসব শাখায় প্রমাণের নিশ্চয়তার আভাস দেকার্তকে আকর্ষণ করে সব চাইতে বেশি। তিনি বুঝতে পারেন এতদিনে নিজের পথ খুঁজে পেয়েছেন।

জেসুইট স্কুলের পড়া শেষ করে দেকার্ত ভর্তি হন পয়টায়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখান থেকে আইনশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন পরীক্ষায়। পাশ করে বেরিয়েই প্যারিস রওনা হলেন। এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করে নানা বইপত্র ঘেঁটে একরকম অগোছালো ভাবেই দুটো বছর কাটিয়ে দিলেন।

ভেতরে কিসের একটা অস্থিরতার আলোড়ন নিজেও বুঝতে পারছিলেন না। সেজন্যই নির্দিষ্ট কোন বিষয়ে মন নিবিষ্ট করতে পারলেন না দুই বছর।

তবে যখনই বইপত্র নিয়ে বসতেন, মনোযোগ থাকত অঙ্কের জটিল তত্ত্বের সমাধানের দিকে।

বলতে গেলে দেকার্তের এই নির্বাসিত জীবনের একমাত্র সঙ্গীই ছিল অঙ্কের বিষয়-আশয়৷

একদিন এক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল পথে। বন্ধুটি নাসুর যুবরাজ মরিসের সেনাদলের স্বেচ্ছাসেবক একজন। তার উৎসাহে দেকার্তও ঢুকে গেলেন ভলেন্টিয়ার্স টিমে। কিছুদিনের মধ্যেই টিমের সঙ্গে চলে আসতে হল হল্যান্ডের ব্রেদা শহরে।

ছোট্ট শহরটা পছন্দ হয়ে গিয়েছিল দেকার্তের। একদিন হাতে বিশেষ কাজকর্ম ছিল না, একমনেই একটা রাস্তা ধরে হাঁটছিলেন।

একটা বাজারের কাছে এসে লক্ষ্য করেন, খুঁটির সঙ্গে লটকান রয়েছে একটা বিজ্ঞাপন ৷ একদঙ্গল লোক খুঁটিঘিরে জড়ো হয়ে বিজ্ঞাপনটা দেখছে আর হুল্লোড় করছে।

দেকার্ত কৌতূহলী হয়ে কাছে এসে একজনকে ভিড় জমাবার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন! জানতে পারলেন, বিজ্ঞাপনটি হল একটি জটিল অঙ্কের ধাঁধা।

অঙ্ক শুনেই আগ্রহ বাড়ল। এবারে ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে রেনে অঙ্কটি পড়লেন। এরপর কয়েক মিনিটের মধ্যেই মুখে মুখে ধাঁধার সমাধান করে দেন।

সৌম্যদর্শন একজন বৃদ্ধ খুঁটির কাছেই বসেছিলেন। তিনিই টানিয়ে ছিলেন বিজ্ঞাপনটি।

দেকার্তের জবাব শুনে তিনি চমৎকৃত হন। দেকার্তের পরিচয় জানার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন।

রেনে জানান, তিনি দিন কতক আগে মরিসের সৈন্যদের সঙ্গে একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ব্রেদায় এসেছেন।

পরিচয় পেয়ে বৃদ্ধ সন্তুষ্ট হলেন বলে মনে হল না। কেন না, এমন কঠিন অঙ্কের ধাঁধাটি যে ব্যক্তি মুখেমুখেই সমাধান করে দিতে পারেন, একজন সামান্য স্বেচ্ছাসেবকই যে তার প্রকৃত পরিচয় নয় তা তিনি ভালই বুঝতে পারলেন।

বৃদ্ধ নিজেও সাধারণ মানুষ ছিলেন না। হল্যান্ডের বিখ্যাত এই অঙ্কবিজ্ঞানী ও গবেষক মানুষটির পরিচয় সকলেই জানতেন। জ্ঞানীগুণী মহলে তাঁর যথেষ্ট নামডাক। নাম আইজাক বেকম্যাল৷

পেশায় চিকিৎসক হলেও অঙ্কের নেশাতেই সারাক্ষণ মেতে থাকতেন বৃদ্ধ ভদ্রলোক। দেকার্তও অঙ্ক পাগল মানুষ। কাজেই কথায় কথায় আলাপ-পরিচয় জমে উঠতে সময় লাগল না। বয়সের ব্যবধান দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে কোন বাধাই হল না।

মেলামেশা আলোচনার মধ্যে অঙ্কই যোগসূত্র। দেকার্তের জীবনে অচিরেই জ্যামিতির চর্চা নতুন মোড় নেয়৷

জ্যামিতির নানা সূত্রের আবিষ্কারের প্রধান দাবিদার প্রাচীন গ্রীক পণ্ডিতগণ। কিন্তু তাদের পথ দেকার্তের কাছে নিতান্তই গতানুগতিক বলে মনে হত। তিনি চাইতেন সহজ সরল যুক্তির পথে জ্যামিতিকে সর্বসাধারণের বোধগম্য করে তুলতে। তাহলে অনেক মানুষই জ্যামিতি চর্চায় উৎসাহ পাবে।

তিনি নিজেই জ্যামিতির একটি ভাগ নতুন করে সাজিয়েছিলেন। তা হল রেখার ব্যবহার ও গ্রাফ বা লেখ -এর দ্বিমাত্রিক নকশা।

রেনে দেকার্ত এর প্রথম জীবন: Rene Descartes’s Early Life

দেকার্ত রেখকের এককগুলোকে অনুভূমিক রেখাও উল্লম্ব রেখ-তে নির্দিষ্ট করে বসান ৷ এর ফলে রেখার ওপর যে কোন এক বিন্দুকে দুই রেখার ওপর নির্দিষ্ট করা দুই সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করা যাবে।

ইউক্লিডের জ্যামিতির মূল নিয়মগুলোকে বজায় রেখে জ্যামিতিও বীজগণিতকে এইভাবে একসূত্রে গেঁথে দেকার্ত তৈরি করেছেন স্থানাঙ্ক বা বিশ্লেষণী জ্যামিতি (Co-ordinate Geometry)।

অসুস্থতা কোন না কোনভাবে জড়িয়েই থাকত দেকার্তের শরীরে। তবু শরীর মনের কষ্ট স্বীকার করেও যুদ্ধবিভাগের কাজে থেকে গেলেন কিছুদিন। তারপর সেখান থেকে এলেন জার্মানি।

সেই সময় জার্মানিতে বাভারিয়ার ডিউকের সেনাদলে স্বেচ্ছাসেবী নেওয়া হচ্ছিল। দেকার্তও ভিড়ে গেলেন সেই দলে।

বছর দেড়েক জার্মানির সৈন্য বিভাগে কাটিয়ে এবারে নিরুদ্দেশ ভ্রমণে বেরলেন মধ্য ইউরোপে।

নানাস্থানে ঘুরছেন বন্ধনহীন ভাবে কিন্তু জ্যামিতি আছে সঙ্গে। সেই সূত্রে সব জায়গাতেই জ্ঞানীগুণীদের সঙ্গে চিন্তার বিনিময় ঘটেছে। ফলে পরিচিতি ছড়িয়েছে সবত্রই।

পূর্ব ইউরোপ ভ্রমণ শেষ করে ফের প্যারিসে যখন ফিরে এলেন তখন সেখানকার শিক্ষিত মানুষের মুখে মুখে দেকার্তের নাম। জ্যামিতির যুক্তি নিয়ে নতুন নতুন চিন্তাভাবনার সুবাদেই তাঁর এই পরিচিতি।

প্যারিসে যে বাড়িতে উঠলেন, অল্পদিনের মধ্যেই সেখানে গড়ে উঠল যুক্তিবাদী মানুষদের মিলনকেন্দ্র।

আলোচনার প্রসঙ্গ থাকে বিজ্ঞানের নানা বিষয়। তবে অবধারিতভাবেই অধিকাংশ সময়ে প্রাধান্য পায় গণিত, বিশেষতঃ জ্যামিতি।

জনমুখে প্রচার শুনে পন্ডিত থেকে পড়ুয়া অনেকেরই যাতায়াত বাড়ে দেকার্তের বাড়িতে। গণিতের সঙ্গে দর্শনের আলোচনায় সমান দক্ষতা দেখান দেকার্ত।

প্যারিসের পাটও চুকল একদিন। তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে এলেন হল্যান্ডে। ১৬২৯ খ্রিঃ থেকে এখানেই পাকাপাকি ভাবে বসবাস আরম্ভ করলেন।

জেসুইট স্কুলের ফাদার মেরিস মারমেন প্যারিস আর হল্যান্ডের মধ্যে প্রায়ই যাতায়াত করতেন। তাঁর মাধ্যমেই প্যারিস আর হল্যান্ডের মধ্যে খবরাখবর আদানপ্রদানের কাজটাও চলত।

হল্যান্ডে অঙ্ক আর দর্শনের গবেষণা নিয়ে থাকলেও আলোকবিজ্ঞান; পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, অ্যানাটমি ও ভেষজবিদ্যার চর্চাও করেছেন গভীরভাবে। তাঁর সব ভাবনা চিন্তা পরীক্ষা নিরীক্ষার বিবরণ একসঙ্গে সাজিয়ে পান্ডুলিপির আকারে দাঁড় করালেন। নাম দিলেন লে মনডে। বই আকারে ছাপাবেন এরকমই মনোগত ইচ্ছা। সময়টা ১৬৩৪ খ্রিঃ।

যথারীতি এই খবরটা একসময় ফাদার মারমেনের মারফত প্যারিসের বিদ্বমহলে ছড়িয়ে পড়ল। আয়োজনও চলতে লাগল। খবর হল, বড়দিনের আগেই বহু বিষয়ের নতুন ভাবনাচিন্তা নিয়ে দেকার্তের বই আত্মপ্রকাশ করবে।

হল্যান্ডে আশায় আশায় দিন গুণছেন দেকার্তও। এরই মধ্যে খবর পাওয়া গেল বাইবেলকে অবমাননার দায়ে ক্যাথলিক আদালত গ্যালিলিওকে দন্ডিত করেছেন।

রেনে দেকার্ত এর কর্ম জীবন: Rene Descartes’s Work Life

সূর্যকে ঘিরে পৃথিবী ঘোরে এই বাইবেল-বিরোধী ঘোষণা করেছিলেন কোপার্নিকাস। গ্যালিলিও কোপার্নিকাসকে সমর্থন জানিয়ে ধর্মদ্রোহিতার মহাপাপের কাজ করেছিলেন।

খবরটা পেয়েই সতর্ক হয়ে গেলেন দেকার্ত। হাত গুটিয়ে নিলেন। প্যারিসে অনুরাগী মহলেও খবর পৌঁছে গেল, ব্যক্তিগত কারণে লে মনডে – এর ছাপার কাজ পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু অদ্ভুত এক ব্যতিক্রমী ঘটনা এই সময়ে চমকে দিল দেকার্তকে। চার্চের দুই ফাদার কার্ডিনাল দে বেরুন ও কার্ডিনাল রিধেল দেকার্তকে লে মনডে বইটি ছাপিয়ে বার করার জন্য উৎসাহ দিয়ে ক্রমাগত চিঠি পাঠাতে লাগলেন।

গ্যালিলিওর খবর পাবার পর থেকে অনিশ্চয়তার দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলেন দেকার্ত। দুই ফাদারের চিঠির আন্তরিক তাগিদে তার মনের দ্বিধার ভাবটা কেটে গেল।

দ্রুত অবশিষ্ট কাজ সম্পূর্ণ করে প্যারিস থেকে লা মনডে প্রকাশের ব্যবস্থা করে ফেললেন।

১৬৩৭ খ্রিঃ ৮ জুন বইটি আত্মপ্রকাশ করল। যা হবার কথা ছিল ১৬৩৪ খ্রিঃ তা হলো তিন বছর পরে।

সত্য প্রকাশের কুন্ঠা ঝেড়ে ফেলেছিলেন দেকার্ত। দীর্ঘ তিন বছর পরে হলেও স্বপ্ন সফল হওয়াতে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলেন। স্থানাঙ্ক জ্যামিতির ওপরেই ভিত ছিল লে মনডে বইয়ের। একই বই প্রকাশিত হল ভিন্ন নামে – ডিসকোর্স অব মেথড।

প্রকাশের আগে থেকেই কানাঘুষার মাধ্যমে দেকার্তের বই নিয়ে চার্চের ফাদারদের মধ্যে কৌতূহল দানা বেঁধে ছিল। সেই সঙ্গে ছিল অহেতুক সংশয়। দেকার্ত বুঝতে পেরেছিলেন তার বই সম্পর্কে ধর্মপিতাদের মন থেকে সংশয় দূর করতে না পারলে তার ভাগ্যেও গ্যালিলিওর পরিণতি ঘটা বিচিত্র নয়। সেইকারণে বই প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি চার্চের কর্তৃপক্ষদের সঙ্গে দেখা করে বোঝালেন যে বাইবেলের কথাই পরম সত্য। তার বিরুদ্ধতা করে কোন নতুন কথা বলা বা নতুন কোন সত্য আবিষ্কারের কথা তার বইতে নেই।

পুরনো কথাকেই সামান্য ঘষামাজা করে নতুন ভাষায় বলবার চেষ্টা করেছেন মাত্র।

দেকার্তর খোলামেলা কথা শুনে চার্চের কর্মকর্তারা আশ্বস্ত হলেন। তারা আর বই খুলে পড়ে দেখবার দরকার মনে করলেন না।

বাইবেলের কথার সঙ্গে আদৌ কোন অমিল দেকার্তের বইতে যে থাকতে পারে এমন সন্দেহও তাঁদের মন থেকে দূর হল। ফলে বইটি ধর্মপিতাদের রোষদৃষ্টি এড়িয়ে যেতে সমর্থ হল।

তথাকথিত চার্চের আধিকারিকদের বুদ্ধিবিবেচনা কেমন হত সেকালে, দেকার্তের এই ঘটনা থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায়। দেকার্তের বইতে নতুন বিস্ফোরক পদার্থ কি বা কতটা ছিল তার হদিস তারা না পেলেও দেশের অনেকেই তা অবিলম্বে জেনে গেলেন।

সেই কানাঘুষো ধর্মপিতাদের প্রভাবিত করবার আগে পর্যন্ত কিছুদিন দেকার্তের নিশ্চিন্তেই কাটল।

শেষ পর্যন্ত কি ঘটবে তা দেকার্ত ভালই জানতেন। তিনি চেয়েছিলেন গোলমাল পাকিয়ে ওঠার আগে বইটা দেশের কিছু মানুষের হাতে পৌঁছে যাক।

যা অবধারিত ছিল তাই ঘটল একসময়ে। হল্যান্ডের প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চের ধর্মকর্তারা সখেদে মন্তব্য প্রকাশ করলেন, দেকার্তের বইটি পুরোপুরি ধর্মবিরোধী। দেকার্ত হলেন প্রথম শ্রেণীর নাস্তিক। তার বই অবিলম্বে বাজার থেকে তুলে না নিলে সাধারণ ধর্মবিশ্বাসী মানুষ উচ্ছন্নে যাবে।

দেকার্তের সৌভাগ্য বলতে হবে, ধর্মপিতাদের নিষেধাজ্ঞা ঘোষিত হবার আগেই হল্যান্ডের যুবরাজ প্রিন্স অব অরেঞ্জ দেকার্তকে অকুণ্ঠ প্রশংসা জানালেন ৷ অবস্থা বেগতিক বুঝতে পেরে যাজকসম্প্রদায় বাধ্য হয়ে ঢোক গিলে ফেললেন, আর উচ্চবাচ্য করলেন না।

নেহাৎ দৈবযোগেই দেকার্তের মাথা বেঁচে গেল। আর তার ফল হল, দেকার্তের নাম দাবানলের মত রাতারাতি সমস্ত ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ল। সেই সঙ্গে বইয়ের প্রচারও বেড়ে গেল বিপুলভাবে।

হল্যান্ডের যুবরাজের সমর্থনের পরে অন্যান্য দেশের রাজারাও দেকার্তকে নতুন চিন্তানায়কের সম্মান দিয়ে অভিনন্দন জানাতে লাগলেন।

ইংলন্ডের রাজা প্রথম চার্লস, ফ্রান্সের সম্রাট ত্রয়োদশ লুই বিজ্ঞানের নতুন নায়ককে নিজেদের দেশে সাদর আমন্ত্রণ জানান।

দেকার্ত পরে এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন। দুই দেশেই তিনি বিপুল ভাবে সংবর্ধিত হয়েছিলেন।

১৬৪৬ খ্রিঃ হঠাৎ শোনা গেল, বোহেমিয়ার সুন্দরী যুবরানী নিজেকে দেকার্তের ভাবশিষ্য বলে প্রচার করেছেন। ঘটনাটা যে দেকার্তের অনুরাগী যারপরনাই উৎসাহিত করল তা বলাই বাহুল্য।

মোট কথা তাঁর বিরুদ্ধে মতামত প্রকাশ করার সব সম্ভাবনার দরজাই এভাবে দিনে দিনে রুদ্ধ হয়ে গেল।

বাইরে যখন নতুন প্রকাশিত বই নিয়ে এত কান্ড চলছে তখন দেকার্তের নিজের সময় কাটছে নানা বিষয়ের জটিল তত্ত্বের ব্যাখ্যায়। সেই সঙ্গে আর একটা কাজ করেন তিনি। প্রতিদিনই নির্দিষ্ট একটা সময়ে চিঠির তাড়া নিয়ে বসেন জবাব লিখতে।

বিচিত্র সব অনুরোধ জানিয়ে দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রতিদিনই অসংখ্য চিঠি এসে জমে৷ দেকার্ত ধৈর্য ধরে সব চিঠিই পড়েন। যত্ন করে যথাযোগ্য জবাব লিখে পাঠিয়ে দেন।

একদিন একটা চিঠি খুলেই চমকে যান। সুইডেনের মহারানী, ক্রিশ্চিয়ানার চিঠি। রানী তাকে তার দেশে যাবার সাদর আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। চিঠিটার খুব একটা গুরুত্ব দেননি তিনি প্রথমে।

কিন্তু একই অনুরোধ জানিয়ে দিনের পর দিন রানীর চিঠি আসতে থাকায় দেকার্ত রানীর উদারতায় মুগ্ধ না হয়ে পারেন না। ১৬৪৯ খ্রিঃ দেকার্ত সুইডেন রওনা হলেন। তাঁর বয়স তখন তেপ্পান্নর কোঠায়।

পাথর আর ভালুকের দেশ বলে সুইডেনের খ্যাতি। সেই দেশ দেকার্তকে রাজার সম্মানে সম্মানিত করল। কয়েকদিন রাজঅতিথি হয়ে কাটালেন। এর মধ্যে একদিন ক্রিশ্চিয়ানা এসে সাক্ষাৎ করলেন। আকুতি জানালেন, তিনি দেকার্তের কাছে দর্শন ও অঙ্ক শিখবেন।

আরও জানালেন, যেহেতু নানা কাজে সময় কম তাই ভোর পাঁচটা থেকেই তিনি রোজ পাঠ নিতে আসবেন।

দেকার্তের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। প্রথমতঃ তিনি এমন ব্যাপারের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন না। দ্বিতীয়তঃ ভগ্ন স্বাস্থ্যের জন্যই অত ভোরে ওঠা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।

কিন্তু রানীকে বোঝাবার চেষ্টা করে কোন ফল হল না। দেকার্তকে তার প্রস্তাবে রাজি হতেই হল।

নির্ধারিত দিনে রাজপ্রাসাদে ক্লাশ নিতে এসে দেকার্তের অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠল। তিনি দেখলেন যে ঘরে তাঁকে পড়াতে হবে সেটি অসম্ভব রকমের ঠান্ডা। বুঝতে পারলেন দিন কয়েকের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়তে হবে তাঁকে। মনে মনে ক্ষুব্ধ হলেও সৌজন্যের খাতিরে মুখে কিছু প্রকাশ করলেন না। রানী ক্রিশ্চিয়ানার অঙ্ক ও দর্শনের শিক্ষা শুরু হল।

রেনে দেকার্ত এর মৃত্যু: Rene Descartes’s Death

কিন্তু তিন মাসও কাটল না। প্রবল নিউমোনিয়ায় শয্যাশায়ী হলেন দেকার্ত। সুইডেন রাজপ্রাসাদের সব চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে শেষ প্রর্যন্ত প্রবল জ্বর আর কাশিতে মারা গেলেন দেকার্ত। সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এই দুঃসংবাদ।

সুইডেনেই সমাহিত হয়েছিলেন দেকার্ত। কিন্তু মৃত্যুর সতের বছর পরে তার মরদেহের কফিন প্যারিসে নিয়ে আসা হয় এবং নির্জন এক সমাধিক্ষেত্রে তাকে পুনঃসমাহিত করা হয়।

অঙ্ক সহ বিজ্ঞানের প্রায় সব শাখাতেই দেকার্তের কিছু না কিছু পরীক্ষা রয়েছে। অনেক সম্ভাবনার কেবল সূত্রটুকু তিনি দেখিয়েছেন, বিস্তৃত ব্যাখ্যায় নামেননি ইচ্ছে করেই।

গ্যালিলিওর পরিণাম পদে পদে তাঁর বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল বিশ্লেষণী জ্যামিতির সঙ্গে বীজগণিত মিশিয়ে স্থানাঙ্ক জ্যামিতির উদ্ভাবন।

তাঁর জ্যামিতি ভাবনাই পরবর্তীকালে লিবনিজ ও নিউটনকে ক্যালকুলাস রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল।

দেকার্তের উদ্ভাবিত সমীকরণের পথেই গ্রাফ ও শংকুর প্রস্থচ্ছদের শ্রেণীচরিত্র নির্ণয় করতে গণিতবিজ্ঞানীদের পথ দেখিয়েছেন।

গাণিতিক পদার্থবিদ্যার অন্তর্গঠনে দেকার্তের অবদান অনস্বীকার্য।

আরও পড়ুন-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here