Rahul Sanskritization Biography In Bengali – রাহুল সাংকৃত্যায়ন জীবনী

Rahul Sanskritization Biography In Bengali – রাহুল সাংকৃত্যায়ন জীবনী
Rahul Sanskritization Biography In Bengali – রাহুল সাংকৃত্যায়ন জীবনী

Rahul Sanskritization Biography: আজ আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি মহান ব্যক্তিদের জীবনী সমগ্র। মহান ব্যক্তি আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা। তাঁদের জীবনের ক্ষুদ্রতম অংশগুলি আমাদের জন্য শিক্ষামূলক হতে পারে। বর্তমানে আমরা এই মহান ব্যক্তিদের ভুলতে বসেছি। যাঁরা যুগ যুগ ধরে তাদের কর্ম ও খ্যাতির মধ্য দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন এবং জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প ও সাহিত্যের জগতে এক অনন্য অবদান রেখেছেন এবং তাঁদের শ্রেষ্ঠ গুণাবলী, চরিত্র দ্বারা দেশ ও জাতির গৌরব বৃদ্ধি করেছেন। সেইসব মহান ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম রাহুল সাংকৃত্যায়ন (Rahul Sanskritization) -এর সমগ্র জীবনী সম্পর্কে এখানে জানব।

Rahul Sanskritization Biography In Bengali – রাহুল সাংকৃত্যায়ন জীবনী

নামরাহুল সাংকৃত্যায়ন
জন্ম৯ এপ্রিল ১৮৯৩, পান্ডাহা, আজমগড়, উত্তর প্রদেশ, ব্রিটিশ ভারত
পিতাগোবর্ধন পাণ্ডে
মাতাকুলবন্তী
নাগরিকত্বভারতীয়
জাতীয়তাভারতীয়
পেশালেখক, প্রাবন্ধিক, পণ্ডিত, সমাজবিজ্ঞান, ভারতীয় জাতীয়তাবাদী, ইতিহাস, ভারততত্ত্ব, দর্শন, বুদ্ধবাদ, তিব্বততত্ত্ব, ব্যাকরণ, বিজ্ঞান, নাটক, রাজনীতি
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার১৯৫৮: সাহিত্য অকাদেমী পুরস্কার, ১৯৬৩: পদ্মভূষণ
মৃত্যুএপ্রিল ১৪, ১৯৬৩ (বয়স ৭০), দার্জিলিং, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

রাহুল সাংকৃত্যায়ন -এক আশ্চর্য বিচিত্র জীবনের নাম। এক বহুমুখী চলমান সৃজনশীলতার নাম।

পরিব্রাজক জীবনের চলা-পথ তাঁকে নিয়ে গেছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। পথকেই তিনি করেছিলেন ঘর। আর এই পথ চলার জীবনেই সৃষ্টি করেছেন বহু বিচিত্র সাহিত্য সম্ভার।

এক বিস্ময়কর অনন্য মনীষা নিয়ে জন্মেছিলেন রাহুল। রাহুলের প্রকৃত নাম কেদারনাথ পাণ্ডে। জন্ম ১৮৯৩ খ্রিঃ ৯ই এপ্রিল উত্তরপ্রদেশে আজমগড় জেলায় এক ব্রাহ্মণ পরিবারে। তাঁর বাবার নাম গোবর্ধন পাণ্ডে। মা কুলবন্তী।

পাঁচ বছর বয়সে রাহুলকে পাঠানো হয় গ্রামের মাদ্রাসায়। সেখানে তিনি উর্দুভাষা শিক্ষা করেন। মাদ্রাসার পাঠ শেষ হলে তাঁর পড়া শুরু হয় প্রাথমিক স্কুলে।

এখানে স্কুলের পড়া শেষ হবার আগেই সেকালের সামাজিক প্রথা অনুযায়ী রাহুলের বিয়ে হয় এবং বৌ থাকত তার বাপের বাড়ি। বৌয়ের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হবার সুযোগ ছিল না।

রাহুল জন্মেছিলেন অদ্ভুত এক ভবঘুরে মন নিয়ে। ঘরে কিছুতেই মন বসতে চাইত না। বয়স ৯ বছর শেষ হতে না হতেই একদিন ঘর ছেড়ে পালালেন তিনি। সোজা গিয়ে উঠলেন বেনারসে এক সাধুর ডেরায়।

কিন্তু সেখানেও বেশি দিন মন টিকল না। ঘরের ছেলে আবার ফিরে এলেন ঘরে।

পরিবারটি ব্রাহ্মণ হলেও তাদের প্রধান কাজ ছিল চাষবাস। রাহুলদের জমি-জমা ছিল। এবারে ছেলেকে ঘরে বাঁধবার জন্য কেদারনাথ ঘরগৃহস্থালীর দায়িত্ব চাপিয়ে দিলেন তাঁর কাঁধে। কিন্তু বাইরের মুক্ত আকাশের স্বাদ যে পেয়েছে, ঘরের খাঁচায় তার মন টিকবে কতদিন? রাহুল আবার ঘর ছেড়ে পালালেন। তখন তাঁর বয়স চোদ্দ বছর।

এবারে আর কোন সাধুর ডেরায় নয়, সোজা চলে এলেন কলকাতায়। সম্পূর্ণ অচেনা এই শহরে থাকার বা খাওয়া-পরার কোন সংস্থান তাঁর ছিল না। কাজের চেষ্টা করে হতাশ হলেন। নিরুপায় হয়ে আবার ফিরে গেলেন গ্রামের বাড়িতে।

কিন্তু ষোল বছর বয়সে মহানগরী কলকাতা আবার তাঁকে ঘর থেকে ছাড়িয়ে আনল। এবারে তাঁকে একটা কাজ জুটিয়ে দিল এক দেশওয়ালী ভাই। কাজটিও চমৎকার। এক খৈনির দোকানে খৈনি বিক্রি করার কাজ। কিন্তু কাজে ঢুকতে না ঢুকতেই ঘটালেন বিপত্তি।

আরও পড়ুন: আবদুস সালাম জীবনী

একদিন পরখ করতে গিয়ে খানিকটা খৈনি মুখে পুরে গিলে ফেললেন। সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান। শেষে তাকে মেডিকেল কলেজে ভর্তি করাতে হয়।

এরপরে খেয়াল হল সন্ন্যাসী হবেন। অমনি ভিড়ে গেলেন এক সাধুর দলে। আর তাদের সঙ্গে থেকে যা রপ্ত হল তা হল গাজা, সিদ্ধি ইত্যাদির নেশা।

পড়শোনার প্রতি একটা সহজাত আকর্ষণ ছেলেবেলা থেকেই ছিল রাহুলের। ভারতের প্রাচীন সাহিত্য পাঠের আকাঙ্ক্ষা জন্মেছিল তাঁর। সেই আকর্ষণই তাঁকে টেনে নিয়ে যেত সাধুসন্ন্যাসীদের ডেরায়।

কিন্তু সাধুর দলে মিশে তিনি অনুভব করলেন, তাদের সাধুর বেশ একটা খোলস ছাড়া কিছু নয়। ধর্মীয় চেতনা বা শিক্ষার লেশমাত্র তাদের মধ্যে নেই।

রাহুলের কিশোর বয়সের এই অভিজ্ঞতাই গড়ে তুলেছিল তাঁর প্রতিবাদী ও যুক্তিবাদী মানসিক গঠন। উত্তরকালে তিনি হয়েছিলেন সমস্ত ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আপসহীন যোদ্ধা। ধর্মান্ধ হিন্দুদের বিরুদ্ধে, কপট ধর্মাচারী, আচার-সর্বস্ব ধর্মবাদী -এই সকলের বিরুদ্ধেই সাধুর দলে মিশে ঘুরতে ঘুরতে তিনি পৌঁছলেন হরিদ্বার। এখান থেকে হিমালয়ের শ্রেষ্ঠ তীর্থগুলো – বদ্রীনাথ, কেদারনাথ ও যমুনোত্রী- গঙ্গোত্রী পরিভ্রমণ করলেন।

এইভাবে মাত্র সতেরো বছর বয়সেই হিমালয় দর্শন সম্পূর্ণ করলেন। হিমালয় থেকে ফিরে তিনি উপস্থিত হলেন বারাণসী। সেই সময়ে বারাণসী ছিল সংস্কৃত শিক্ষার প্রধান কেন্দ্র।

আরও পড়ুন: পিয়ের লাপলাস এর জীবনী

বলাবাহুল্য, স্থান মাহাত্যেই যেন রাহুলের মধ্যে জেগে উঠল জ্ঞানের তীব্র আকাঙ্ক্ষা। তাই শুরু করলেন সংস্কৃত শিক্ষা। জন্মসূত্রেই তিনি লাভ করেছিলেন আসাধারণ মেধা।

ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই সংস্কৃত ভাষা আয়ত্ত করলেন এবং পড়তে লাগলেন নানান শাস্ত্রগ্রন্থ।

রাহুল সংস্কৃত শাস্ত্র পরীক্ষার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন। কিন্তু তাঁর মুক্ত উদার চিন্তা-ভাবনা এই উপাধি পরীক্ষার পরীক্ষকদের পছন্দ হয়নি, পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হতে পারেননি।

বারাণসী অবস্থানকালেই তিনি একটি স্কুলে ইংরাজি ও অঙ্ক শিক্ষা করলেন। কিন্তু ভেতরের ভবঘুরে মানুষটি কতদিন নিশ্চুপ থাকতে পারে? চিরজীবনের মতো স্কুলের পাট চুকিয়ে এক সাধুর কাছে দীক্ষা নিয়ে পুরোপুরি সাধু হয়ে গেলেন। দীক্ষার পর তাঁর নাম হল রামউদার দাস।

এরপর একবছর ধরে ভারতের নানাপ্রান্তে ঘুরে বেড়ালেন। লাভ করলেন বিচিত্র অভিজ্ঞতা। দক্ষিণ-ভারত পরিভ্রমণকালে তিনি তামিল ভাষাও শিক্ষা করেছিলেন।

রাহুল তাঁর এই ভারত-পরিক্রমা কালেই ভারতবর্ষের সমাজ সংস্কৃতি ও ধর্মের প্রকৃত রূপ অন্তর দিয়ে অনুভব করতে পেরেছিলেন।

তিনি দেখেছিলেন, ধর্মের নামে যুক্তি-চিন্তা হারিয়ে দেশের সাধারণ মানুষ কী নিদারূণ অজ্ঞতায় ডুবে আছে।

ঘুরতে ঘুরতে তিনি উপস্থিত হলেন অযোধ্যায়। এখানে দয়ানন্দ সরস্বতীর আর্যসমাজের সদস্যদের সঙ্গে পরিচিত হন। এখানেও মন্দিরে মন্দিরে ধর্মের নামে ভন্ডামি দেখে তাঁর যুক্তিবাদী মন বিদ্রোহ করে উঠল।

এক জনসভায় তাঁর মনের ক্ষোভ তীব্র ভাষায় ব্যক্ত করলেন। তাঁর এই প্রতিবাদে পুরোহিত সমাজ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। বাধ্য হয়ে রাহুল সংকল্প নিলেন আর মুখে নয়, এবার থেকে লিখেই তাঁর ক্ষোভ ব্যক্ত করবেন, ধর্মের মুখোশধারীদের মুখোশ খুলে দেবেন।

আরও পড়ুন: হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা জীবনী

এই সময় থেকেই রাহুলের জীবন এক নতুন পথে মোড় নিতে থাকে। তাঁর অস্তস্থিত প্রতিবাদী মানুষটির ঘটে জাগরণ।

সংসার ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর রাহুলের বৃদ্ধ বাবা সাধ্যসাধনা করেছেন তাঁকে ঘরে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। সংসারে ছিল তাঁর তরুণী স্ত্রী। বাবার অনুরোধে রাহুল মাত্র একবারই ১৯১৫খ্রিঃ বাড়িতে ফিরে গিয়েছিলেন। পত্নীর সঙ্গে সাক্ষাৎও হয়েছিল। কিন্তু গৃহজীবনে বাঁধা পড়েননি রাহুল। আবার বেরিয়ে পড়লেন পথে।

অযোধ্যায় আর্যসমাজের কার্যকলাপ তাঁকে সাময়িকভাবে হলেও আকৃষ্ট করেছিল। এই সময়েই তিনি সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, ধর্মশাস্ত্র প্রভৃতি বিষয়ে প্রচুর পড়াশুনার সুযোগ পেয়েছিলেন।

বিভিন্ন সংবাদপত্রের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ের খবরাখবরের সঙ্গেও তিনি পরিচিত হয়েছিলেন। আর্য সমাজের যুক্তিবাদী চিন্তাভাবনার প্রভাবে আসার পরে রাহুল হিন্দুধর্মের সমস্ত কুসংস্কার ও নিরর্থক আচার-অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠলেন। সূত্রপাত হল তাঁর লেখকজীবনের

মুসাফির ও ভাস্কর নামে দুটি উর্দু পত্রিকা প্রকাশিত হত মিরাট থেকে। রাহুল এই পত্রিকা দুটিতে লিখতে শুরু করলেন।

এই সময়ে তিনি কিছুদিন আর্য সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে ভারতবর্ষের বিভিন্ন শাখাকেন্দ্রগুলি ঘুরে বেড়ান।

কিন্তু সংঘগুলির কাজকর্ম ও কর্মীদের চিন্তাভাবনা তাঁকে হতাশ করেছিল। তাই পথই আবার হল তাঁর সঙ্গী।

রাহুল এলেন বারাণসী, সেখান থেকে ভগবান বুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত সারনাথে। সারনাথ ভ্রমণ এবং বুদ্ধদেবের জীবন ও দর্শন তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। পরবর্তীকালে রাহুল বৌদ্ধধর্মমতে দীক্ষিত হয়েছিলেন।

বুদ্ধদেব মহানির্বাণ লাভ করেছিলেন গোরখপুরে কুশী নদীর তীরে। সারনাথের পরে রাহুল দর্শন করেন গোরখপুর।

সেখান থেকে গেলেন নেপালের লুম্বিনী আর কপিলাবস্তুতে। বস্তুতঃ বুদ্ধজীবন ও বৌদ্ধভাবধারা রাহুলকে এতটাই আকৃষ্ট করেছিল যে অন্তর্নিহিত প্রেরণাতেই তিনি বৌদ্ধতীর্থগুলি ঘুরে ঘুরে দর্শন করেছিলেন।

ইতিমধ্যে ১৯১৯ খ্রিঃ ১৩ই এপ্রিল ঘটে যায় পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকান্ড। ফলে ইংরাজের নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে গোটা দেশ জুড়ে জনজাগরণের বিস্ফোরণ ঘটে। ভবঘুরে রাহুলও এই ঘটনায় বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন।

১৯২১ খ্রিঃ গান্ধীজির নেতৃত্বে ভারত জুড়ে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। রাহুল এবারে জনজীবন থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারলেন না।

গেরুয়া বেশধারী সন্ন্যাসী যোগ দিলেন অসহযোগ আন্দোলনে। এই সময়ে তিনি কংগ্রেসের হয়ে বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে ঘুরে বক্তৃতা করেন।

জনজাগরণের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিয়ে কেবলমাত্র রাজনৈতিক প্রচারের কাজেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখলেন না। গ্রামে গ্রামে দীন-দুঃখী মানুষের সেবায় অকুণ্ঠ সহযোগিতা জুগিয়েছেন।

ফলে অল্প দিনের মধ্যেই স্বদেশীকর্মী হিসেবে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ল এবং তিনি গ্রেপ্তার হলেন ১৯২২ খ্রিঃ ৩১শে জানুয়ারি। ছয় মাসের কারাদন্ডের আদেশ হল রাহুলের। তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হল বক্সার জেলে। সেই সময়ে এখানেই রাখা হত রাজনৈতিক বন্দিদের।

আজন্ম জ্ঞানপিপাসু রাহুল কারাবাসের দিনগুলিতেও নিষ্ক্রিয় ছিলেন না। জেলে বসেই তিনি সংস্কৃত ভাষায় কোরানের অনুবাদ করলেন, লিখলেন ব্রজবুলি ভাষায় বেশ কিছু কবিতা।

রাহুল জেল থেকে বিভিন্ন খবর গোপনে বাইরে পাচার করে দিতেন। সেসব খবর ছাপা হত মাদারল্যান্ড নামে একটি পত্রিকায়। এই পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন মাযহারুল হক।

গোপন পথে জেলের বাইরে থেকে রাহুলের কাছেও আসত নানান বইপত্র ও সংবাদপত্র। এই সময়েই একদিন তাঁর হাতে পৌঁছায় রাশিয়ার বিপ্লবী নেতা ট্রটস্কির লেখা বলশেভিজম অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড রেভল্যুশন।

ইতিপূর্বেই সংবাদপত্র মাধ্যমে রাশিয়ার বিপ্লব ও সাম্যবাদ সম্পর্কে রাহুল জানতে পেরেছিলেন। ট্রটস্কির বইটি পড়বার পর তিনি সাম্যবাদের বিষয়ে কৌতূহলী হয়ে ওঠেন।

জেল থেকে মুক্তি পাবার পর রাহুলকে দেওয়া হল জেলা কংগ্রেসের দায়িত্ব। বস্তুতঃ এই সময়ে কংগ্রেসের কাজকর্ম করলেও রাহুল ক্রমেই সাম্যবাদের আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছিলেন।

১৯২৩ খ্রিঃ পশুপতিনাথ দর্শনের জন্য তিনি নেপাল গেলেন। সেখানে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের সংস্পর্শে আসেন এবং দেড় মাস তাঁদের সঙ্গে থেকে বৌদ্ধধর্ম সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় জানতে পারেন।

দেশে ফিরে আসতেই তিনি আবার বন্দি হলেন। এবারে তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হল বাঁকিপুর জেলে।

কারাকক্ষে এবারে তাঁর সঙ্গী ছিল পালি ভাষায় লেখা একটি ধর্মগ্রন্থ মজঝিম নিকায়। এই সময়ে তিনি জেলে বসে চারটি ইংরাজি উপন্যাসের হিন্দী অনুবাদ করেন। এছাড়া গ্রহমন্ডলীর একটি মানচিত্রও তৈরি করেছিলেন।

বাঁকিপুর জেল থেকে কিছুদিন পরে রাহুলকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় হাজারিবাগ জেলে। এখানে বসেই তিনি ফার্সী ও আবেস্তা ভাষার চর্চা করেন।

রাহুলের ছিল অদম্য জ্ঞানপিপাসা। তাই নির্দিষ্ট কোন বিষয়ের মধ্যেই তিনি কখনো আবদ্ধ থাকতেন না। যখন যেই বিষয়ের বই হাতে পেতেন তার মধ্যেই ডুবে যেতেন। দু’বছর পরে রাহুল যখন জেল থেকে ছাড়া পেলেন তখন কংগ্রেসের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করেছে।

নরমপন্থী ও মধ্যমপন্থী, দলের মধ্যে এই দুই গোষ্ঠীর বিভাজন ক্রমশ‍ই প্রকট হয়ে উঠছিল। গান্ধীজি ও তাঁর অনুগামীরা ছিলেন নরমপন্থী দলে। আর মতিলাল নেহরু, বল্লভভাই প্যাটেল, চিত্তরঞ্জন দাশ -এই নেতৃবৃন্দ ছিলেন মধ্যপন্থী ।

দেশের নেতাদের মধ্যে এই বিরোধ দেখে রাহুল রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেললেন। তিনি সব ছেড়েছুড়ে আবার নেমে পড়লেন পথে। এবারে গেলেন কাশ্মীর। সেখান থেকে লাদাখ ও তিব্বতের পশ্চিম প্রান্ত ঘুরে ফিরে আসেন।

বৌদ্ধ ধর্ম-দর্শন রাহুলকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করেছিল। তাই ভ্রমণ-পর্ব শেষ করে তিনি কলকাতায় এসে মহাবোধি সোসাইটির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করলেন।

বৌদ্ধধর্মের প্রতি রাহুলের অনুরাগ দেখে মহাবোধি সোসাইটি তাঁকে শ্রীলঙ্কায় যাবার ব্যবস্থা করে দিল। সেই সময় বৌদ্ধ ধর্ম-দর্শন শিক্ষার অন্যতম কেন্দ্র ছিল শ্রীলঙ্কা।

১৯২৭খ্রিঃ ১৬ই মে থেকে শ্রীলঙ্কার বিদ্যালংকার জ্ঞানপীঠে দীর্ঘ ঊনিশ মাস রাহুল বৌদ্ধ ধর্ম-দর্শন নিয়ে পড়াশুনা করেন।

এই সময়ে তিনি সিংহলী ও ফরাসী ভাষাও শিক্ষা করেন। শ্রীলঙ্কায় অবস্থান কালেই তিব্বতে সংরক্ষিত বৌদ্ধধর্মের প্রাচীন পুঁথি বিষয়ে রাহুল অবগত হন।

১২০২খ্রিঃ বখতিয়ার খলজির ভারত আক্রমণকালে তালপাতায় লেখা বহু প্রাচীন বৌদ্ধ পুঁথি নিয়ে বৌদ্ধভিক্ষুরা নিষিদ্ধ দেশ তিব্বতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। সেই মূল্যবান সম্পদ সেখানকার লামাদের তত্ত্ববধানেই রক্ষিত ছিল। রাহুল সংকল্প করলেন তিব্বতে গিয়ে এই পুঁথি উদ্ধার করবেন।

সেই সময়ে ইংরাজ সরকার কোন ভারতীয়কেই তিব্বতে যাবার অনুমতি দিত না। তাছাড়া পথও ছিল দুর্গম, বিপদসঙ্কুল। কিন্তু কোন বাধাই রাহুলকে সঙ্কল্পচ্যুত করতে পারল না।

ভারত থেকে তিব্বতে যাবার পথ নেপালের মধ্য দিয়ে। তাই রাহুল প্রথমে গেলেন নেপালে। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে গোপনে তিনি উপস্থিত হলেন নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে।

এখান থেকে ভিড়ে গেলেন কিছু তিব্বতি ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তারা তিব্বতের চাল আর সবজির বিনিময়ে নেপাল থেকে লবন নিয়ে তিব্বতে ফিরছিল।

রাহুল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে উপস্থিত হলেন নেপাল সীমান্তে। এই সময় তিনি নিজের পরিচয় দিলেন রং লামা নামে একজন বিখ্যাত লামার শিষ্য হিসেবে। পথে একজন বৌদ্ধভিক্ষুকে সঙ্গী হিসেবে পেলেন রাহুল। তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ পাহাড়ি পথ কখনো পায়ে হেঁটে কখনো ঘোড়ার পিঠে চেপে পাড়ি দিয়ে তিনি উপস্থিত হলেন নারথাং বৌদ্ধ গুম্ফায়।

এখানে তিনি বহু প্রাচীন পুঁথির সন্ধান পেলেন। অবশেষে সেখান থেকে নৌকাপথে ও পায়ে হেঁটে এসে পৌঁছলেন তিব্বতের রাজধানী লাসায়।

ধর্ম সাহু নামে লাসার এক ব্যক্তির সঙ্গে রাহুলের পরিচয় হয়েছিল নেপালে। লাসায় পৌঁছে তিনি তার বাড়িতেই আশ্রয় পেলেন।

তিব্বতীরা বিদেশীদের পছন্দ করত না। তাই রাহুলকে এখানে দলাইলামার শিষ্য বলে পরিচয় দিতে হয়েছিল এবং এই সূত্রে বহু প্রাচীন পুঁথির সন্ধান পান। তাঁর ইচ্ছা ছিল বছর তিনেক তিব্বতে থেকে সেসব পুঁথি নিয়ে গবেষণা করবেন। কিন্তু আর্থিক কারণে এক বছর তিনমাস পরেই তাঁকে তিব্বত থেকে ভারতে ফিরে আসতে হয়েছিল।

দেশে ফেরার সময় রাহুল বহু দুর্লভ পুঁথি, প্রাচীন চিত্রকলা, পট প্রভৃতি নগদ অর্থে কিনে নিয়েছিলেন। তারপর সমস্ত সংগ্রহ ১৮টি টাট্টুঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে ১৯৩০ খ্রিঃ ২৪শে এপ্রিল লাসা থেকে রওনা হয়ে ৩৯ দিন পরে এসে পৌছলেন কালিম্পং।

রাহুল যে সমস্ত পুঁথি সংগ্রহ করেছিলেন তার মধ্যে ছিল বৌদ্ধশাস্ত্র, ধর্মদর্শন, ইতিহাস, শিল্পকলা, ভূগোল, জীবনী, চিকিৎসা ব্যবস্থা ও প্রাচীন যুগের সমাজ বিষয়ে বহু মূল্যবান তথ্য।

সংগৃহীত সমস্ত দ্রব্যই রাহুল পাটনা মিউজিয়মকে উপহার দিয়েছিলেন। রাহুল এর পরেও ১৯৩৪ খ্রিঃ থেকে ১৯৩৮ খ্রিঃ পর্যন্ত আরও তিনবার তিব্বতে গিয়েছিলেন এবং প্রতিবারেই অজস্র পুঁথি সংগ্রহ করে এনেছিলেন।

রাহুলের জীবন ছিল নিত্য পরিবর্তনশীল। নিরন্তর তিনি যেমন স্থান পরিবর্তন করে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছেন, তেমনি তাঁর মনও সময় থেকে সময়ান্তরে বিচরণ করেছে নানান বিষয়ে।

ভাবতে আশ্চর্য লাগে যে পারিপার্শ্বিকের প্রয়োজন মেনে তিনি বহুবার নিজের নামেরও পরিবর্তন ঘটিয়েছেন।

কেদারনাথ পাণ্ডে নামের মানুষটিই যখন হিন্দু ধর্মসংঘের সঙ্গে যুক্ত হলেন, নতুন নাম নিলেন রামউদার দাস।

কিছুদিন পরেই আবার ঘটল নামের পরিবর্তন। হলেন রামউধার সিং। তারপর যখন বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হলেন বুদ্ধপুত্রের নামে নিজের নামকরণ করলেন রাহুল সাংকৃত্যায়ন। নামের এই বিচিত্র পরিবর্তন তিনি ঘটিয়েছিলেন জ্ঞান আহরণের প্রয়োজনে।

বৌদ্ধ ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে ছিল দুটি প্রধান শাখা। হীনযান ও মহাযান। নেপাল ও তিব্বত থেকে রাহুল সংগ্রহ করেছিলেন মহাযান শাখার পুঁথি। আবার হীনযান তত্ত্বের সূত্রাদি আয়ত্ত করার জন্য তিনি গিয়েছেন শ্রীলঙ্কায়।

দুটি সম্প্রদায়ের মূলগত তত্ত্বের সন্ধান করার জন্য রাহুলকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছিল। তাঁকে শিখতে হয়েছিল সংস্কৃত, পালি, সিংহলী ও তিব্বতি ভাষা।

ধর্ম ও দর্শনের প্রতিটি বিষয় তিনি আয়ত্ত করেছিলেন। তাই এক সময়ে দুই সম্প্রদায়ের ঐক্যের প্রয়াসে তিনি উদ্যোগী হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর উদ্যোগ ফলপ্রসূ হয়নি।

জন্ম-পরিব্রাজক রাহুলের পদযাত্রা কেবল ভারতবর্ষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ১৯৩২ খ্রিঃ তিনি সমুদ্র পার হয়ে গিয়েছিলেন ইউরোপে। ভ্রমণ করেন ফ্রান্স ও জার্মানী। পরে জাপান কোরিয়া ও মাঞ্চুরিয়া হয়ে উপস্থিত হন মস্কোয়।

যখন যে দেশে তিনি গেছেন, সেখানকার দার্শনিক পণ্ডিতদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে। তাঁর পাণ্ডিত্য ও প্রজ্ঞায় মুগ্ধ হয়েছেন সকলেই।

আরও পড়ুন: মাদার টেরিজা জীবনী

প্রসিদ্ধ রুশ দার্শনিক, বৌদ্ধ ন্যায়শাস্ত্রের অধ্যাপক শ্চেরবটসকী তাঁর স্মৃতিকথায় মন্তব্য করেছেন, ‘বৌদ্ধ ন্যায়শাস্ত্র বিষয়ে যথাযথ অধ্যাপনা করতে পারেন পৃথিবীতে এমন মানুষ একজনই আছেন। তিনি হলেন রাহুল সাংকৃত্যায়ন’।

অথচ আশ্চর্য এই যে মহাপণ্ডিত ও প্রাজ্ঞ এই মানুষটির ছিল না প্রথাগত কোন শিক্ষা। সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টা ও উদ্যম সহায়ে তিনি অধিগত করেছিলেন সমস্ত বিদ্যা। তাঁর অসাধারণ জ্ঞান ও সুগভীর মননের পরিচয় রয়েছে তাঁর রচিত প্রতিটি গ্রন্থের মধ্যে। রাহুল মস্কো থেকে বাকু হয়ে যান ইরানে। সেখানকার বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করে ফিরে আসেন ভারতবর্ষে।

১৯৩৭ খ্রিঃ সোভিয়েত আকাদেমির আমন্ত্রণে রাহুল দ্বিতীয়বার রাশিয়ায় যান। সেই সময়ে আকাদেমির ভারতীয়-তিব্বত বিভাগের উদ্যোগে সংস্কৃত তিব্বতি ভাষাকোষ সংকলনের কাজ চলছিল। সেই কাজে ব্রতী ছিলেন আকাদেমির অন্যতম কর্মী মিসেস লোলা। তাঁর সম্পূর্ণ নাম ছিল এলেনা ন্যাভারটোভনা কোজেরেবস্কায়া।

এখানেই লোলার সঙ্গে পরিচয় হয় রাহুলের। তিনি তাঁকে শেখাতেন সংস্কৃত আর নিজে লোলার কাছে শিখতেন রুশ ভাষা।

এই সূত্রেই দুজনের মধ্যে গড়ে উঠল ঘনিষ্ঠতা এবং অল্পদিনের মধ্যেই দুজন দুজনকে ভালবেসে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন।

বিবাহের তিন মাস পরেই রাহুল ভারতবর্ষে ফিরে আসেন। লোলা থেকে যান লেনিনগ্রাদে।

কয়েক মাস পরেই রাহুল ও লোলার প্রথম পুত্র ইগোর জন্ম হয়। দেশে বসেই পুত্রের জন্মের সংবাদ পান তিনি।

দীর্ঘ সাত বছর পর ১৯৪৫ খ্রিঃ রাহুল তৃতীয়বার রাশিয়া গেলে পত্নী ও পুত্রের সঙ্গে মিলিত হন। স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে এক বছর ছিলেন তিনি। কিন্তু ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সরকারী অনুমতি না পাওয়ায় স্ত্রী-পুত্রকে ভারতবর্ষে নিয়ে আসতে পারেননি।

আরও পড়ুন: গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য জীবনী

রুশ দেশে অবস্থানকালে রাহুল সাম্যবাদের আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হন। চিন্তাজগতে মার্কসীয় প্রবল প্রভাব নিয়ে ভারতে ফিরে এসে তিনি ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন।

অল্পদিনের মধ্যেই তিনি কৃষক আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী হয়ে ওঠেন। ফলে এই সময়ে তাঁকে বন্দী অবস্থায় মাস কয়েক জেল খাটতে হয়। কিন্তু সেখানেই শেষ হল না রাহুলের বন্দিজীবন। প্রথমবার মুক্তিলাভের পর কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবার অপরাধে পুনরায় তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং এই দফায় তাঁর কারাবাস হয় দীর্ঘ আড়াই বছর।

কারাগারে বসে রাহুল রচনা করলেন তাঁর দুটি বিখ্যাত বই -ভোলগা থেকে গঙ্গা ও দর্শন দিগ্‌দর্শন।

১৯৪২ খ্রিঃ ভারতবর্ষ যখন স্বাধীনতার আন্দোলনে উত্তাল, রাহুল জেল থেকে ছাড়া পেলেন। সেই সময় তাঁর বয়স পঞ্চাশ। এই সময়ে তিনি দিন কতকের জন্য গ্রামের বাড়িতে ফিরে গিয়েছিলেন। ষোল বছর বয়সে ছেড়ে আসা গ্রামে ততদিনে অনেক কিছুরই পরিবর্তন ঘটেছে। তবে সঙ্গীসাথীদের মধ্যে অনেকের সঙ্গেই দেখা হওয়ায় আনন্দ পেলেন।

অবহেলায় পরিত্যাগ করে যাওয়া নিজের স্ত্রীর সঙ্গেও এসময়ে সাক্ষাৎ হয় রাহুলের। কিন্তু তাঁকে পুনরায় গ্রহণ করবার কোন উপায় ছিল না তাঁর।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সেই উত্তাল দিনগুলোতে যখন দেশবাসী অকাতরে প্রাণ বিসর্জন করে, গ্রেপ্তার বরণ করে দেশমুক্তির সোপান রচনা করছে, রাহুলের অন্তরে তার কোন ছায়াপাত ঘটেছে বলে মনে হয় না ।

কেননা দেখা গেল, স্বদেশের মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত না করে তিনি পাড়ি জমালেন রাশিয়ায়। সেখানে লেনিনগ্রাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজে যোগ দিলেন।

ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৪৮ খ্রিঃ রাহুল ফিরে এলেন ভারতে। ততদিনে তাঁর শরীব ভেঙ্গে পড়তে শুরু করেছে। এই সময়টা তিনি নিজের লেখালিখি নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন।

রাহুলের ঘটনাবহুল অস্থির জীবনের শেষপর্বে এক নতুন অধ্যায় সংযোজিত হল। কমলা পেরিয়ার নামে এক বিদুষী নেপালী মহিলাকে বিবাহ করলেন তিনি। কমলা ছিলেন স্বামীঅনুগতা সুগৃহিণী। স্বামীর নানাকাজে নানাভাবে সাহায্যও করতেন তিনি।

এই নতুন সংসারে রাহুলের এক কন্যা জয়া ও এক পুত্র জেতার জন্ম হয়। স্ত্রী পুত্রকন্যা নিয়ে এতদিনে এক পরিপূর্ণ সংসারলাভ করলেন রাহুল। এরপর তিনি কিছুদিনের জন্য গিয়েছিলেন চীনে। সেখান থেকে ফিরে শ্রীলঙ্কায় বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের অধ্যাপনা করেন। দেশে ফিরে আসেন ১৯৪৮ খ্রিঃ।

গুরুতর অসুস্থ অবস্থা নিয়েই ফিরেছিলেন রাহুল। ক্রমশই শরীর অসাড় হয়ে পড়তে লাগল। ক্রমে স্মৃতি হারিয়ে যেতে আরম্ভ করল, কথাও হল রুদ্ধ। ডাক্তাররা জানালেন, এ হল দুরারোগ্য অ্যামনেসিয়া রোগ। যা মানুষকে নির্বাক বোধহীন করে ফেলে।

চিকিৎসার জন্য রাশিয়া নিয়ে যাওয়া হল রাহুলকে। এই সময়ে স্ত্রী লোলা এসেছিলেন তাঁকে দেখতে। রাহুল কোন কথা বলতে পারেননি, কেবল তাকিয়ে দেখেছেন স্ত্রীকে, চোখ ছিল অশ্রুপূর্ণ।

চিকিৎসায় কোন ফল না হওয়ায় রাহুলকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হল দার্জিলিং। সেখানেই ১৯৪৮ খ্রিঃ ১৪ এপ্রিল তাঁর বিচিত্র জীবনের অবসান ঘটে।

জীবনের পর্বে পর্বে ঘোরতর অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে থেকেই প্রাজ্ঞ রাহুল সাংকৃত্যায়ন রচনা করেছেন বিশাল বিচিত্র সাহিত্য সম্ভার।

তাঁর সাহিত্যজীবনের বিস্তৃতি ছিল ১৯২৭ খ্রিঃ থেকে ১৯৪৮ খ্রিঃ পর্যন্ত এই সময়ের মধ্যে অবিশ্রান্তভাবে তিনি লিখে গেছেন, উপন্যাস, গল্প, ভ্রমণকাহিনী, প্রবন্ধ, ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস, অনুবাদ। সেই সঙ্গে আত্মকথা, জীবনীমূলক গ্রন্থ, অভিধান, লোকসাহিত্য সংকলন নিয়ে প্রায় ১২৫ টি গ্রন্থ। এবং তাঁর প্রতিটি রচনাই সুনিপুণ রচনাশৈলীর গুণে সাহিত্যের স্থায়ী সম্পদরূপে পরিগণিত হয়েছে।

আরও পড়ুন: রাহুল সাংকৃত্যায়ন উইকিপিডিয়া

তাঁর রচনার ভাষা সহজ সরল, প্রাণবন্ত, সহজেই তা পাঠকের মনে রেখাপাত করে। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে সংজীবিত রচনার মাধ্যমে রাহুল পাঠককে দিয়েছেন জ্ঞান ও সত্যের আলোকের সন্ধান, এক মহত্তর জীবনের দিশা। একারণেই ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাসে রাহুল সাংকৃত্যায়ন এক অবিস্মরণীয় নাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here