Kazi Nazrul Islam Biography: আজ আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি মহান ব্যক্তিদের জীবনী সমগ্র। মহান ব্যক্তি আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা। তাঁদের জীবনের ক্ষুদ্রতম অংশগুলি আমাদের জন্য শিক্ষামূলক হতে পারে। বর্তমানে আমরা এই মহান ব্যক্তিদের ভুলতে বসেছি। যাঁরা যুগ যুগ ধরে তাদের কর্ম ও খ্যাতির মধ্য দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন এবং জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প ও সাহিত্যের জগতে এক অনন্য অবদান রেখেছেন এবং তাঁদের শ্রেষ্ঠ গুণাবলী, চরিত্র দ্বারা দেশ ও জাতির গৌরব বৃদ্ধি করেছেন। সেইসব মহান ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম কবি কাজী নজরুল ইসলাম -এর সমগ্র জীবনী সম্পর্কে এখানে জানব।
Kazi Nazrul Islam Biography In Bengali – কাজী নজরুল ইসলাম জীবনী
নাম | কাজী নজরুল ইসলাম |
জন্ম | ২৪শে মে ১৮৯৮, বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে |
পিতা | কাজী ফকির আহমেদ |
মাতা | জাহেদা খাতুন |
ছদ্দনাম | দুখু মিয়া |
পেশা | কবি, ঔপন্যাসিক, গীতিকার, সুরকার, নাট্যকর ও সম্পাদক |
উল্লেখযোগ্য কর্ম | নজরুলগীতি, অগ্নিবীণা, বাঁধন হারা, বিষের বাঁশি প্রভৃতি |
মৃত্যু | ২৯ আগস্ট ১৯৭৬, ঢাকা, বাংলাদেশ |
কাজী নজরুল ইসলাম এর জন্ম স্থান ও পিতামাতা: Birth Place And Parents Of Kazi Nazrul Islam
বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট কবি, গীতিকার এবং সাহিত্যিক, বিদ্রোহী কবি রূপেই প্রধানতঃ তাঁর প্রতিষ্ঠা এবং পরিচিতি। বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে ১৯০০ খ্রিঃ ২৪ শে মে, বাংলা ১৩০৬, ১১ ই জ্যৈষ্ঠ নজরুলের জন্ম।
তাঁর পিতা কাজী ফকির আহমদ ছিলেন ধর্মপ্রাণ ও সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তি। কিন্তু দারিদ্র্য ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। এই দরিদ্র পরিবারে জন্মে দুঃখ দরিদ্রের সঙ্গে সমাজের অসম ব্যবস্থার বাস্তব রূপটি প্রত্যক্ষ করবার সুযোগ ঘটেছিল নজরুলের বাল্যকাল থেকেই।
এই সময়েই একটি বিদ্রোহী ভাব তাঁর মনের গভীরে জন্মলাভ করেছিল এবং এই মনোভাব নিয়েই তিনি আজীবন সমস্ত অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, শোষণ, পীড়ন ও অব্যবস্থার বিরুদ্ধে সৈনিকের মত সংগ্রাম করে গেছেন।
কাজী নজরুল ইসলাম এর ছোটবেলা: Kazi Nazrul Islam’s Childhood
শৈশবে গ্রামের মক্তবে সামান্য লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন নজরুল। বাংলা ভাষার সঙ্গে আরবী ও ফারসী এই সময়ই তিনি শিক্ষা করেন। বাল্যকালেই চুরুলিয়ার পল্লীকবিদের প্রতি নজরুল অনুরক্ত হন।
তিনি নিজেও মুখে মুখে কবিতা রচনা করে পল্লীবাসীদের প্রশংসা অর্জন করেন। ১৩-১৪ বছর বয়সে নজরুল উর্দু গজল গেয়ে কবিগানের আসর জমিয়ে শ্রোতাদের তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। বালা বয়সেই লেটো দলের জন্য চাষার সং, শকুনি বধ পালাগান রচনা করেন।
কাজী নজরুল ইসলাম এর প্রথম জীবন: Kazi Nazrul Islam’s Early Life
বাল্যকালে নজরুল অত্যন্ত দুরন্ত প্রকৃতির ছিলেন। বাঁধাধরা নিয়মে থাকা ছিল তাঁর স্বভাব-বিরুদ্ধ। স্কুলের জীবন থেকে মুক্ত হয়ে তিনি পালিয়ে গেলেন রানী গঞ্জে। এক রুটির দোকানে পাঁচটাকা বেতনে কিছুদিন কাজ করেন।
সেখান থেকে জনৈক সহৃদয় দারোগার বদান্যতায় পুনরায় তাঁর স্কুল জীবন শুরু হয়। তিনি যখন দশম শ্রেণীর ছাত্র সেই সময় শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।
দেশপ্রেমের আহ্বানে নজরুল ১৯১৪ খ্রি ৪৯ নং বাঙ্গালী পল্টনে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন।
বাহিনীর সঙ্গে তাঁকে চলে যেতে হয় করাচীতে। শুরু হল নজরুলের সৈনিক জীবন, সেই সঙ্গে তাঁর কবি জীবনও।
করাচীর সেনানিবাসেই দীওয়ান-ই-হাফেজ -এর কিছু রুবাই বাংলায় অনুবাদ করেন। রিক্তের বেদন বই -এর গল্পগুলিও আরব সাগরের বিজন বেলায় বসে লেখা।
কাজী নজরুল ইসলাম এর রচনা: Written by Kazi Nazrul Islam
গান-গল্পকবিতা সে সময়ে অজস্র ধারায় নজরুলের লেখনী থেকে বেরিয়ে আসে। তিনি সেসব লেখা পাঠিয়ে দিতেন বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়।
যুদ্ধক্ষেত্রে লেখা রচনাগুলির শেষে লেখা থাকত হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলাম। ফলে হাবিলদাব কবি নামেই তিনি প্রথম জীবনে পরিচিত হয়েছিলেন। তদানীন্তন সওগাত পত্রিকায় নজরুলের লেখা বাউন্ডুলের আত্মকাহিনীতে তাঁর জীবনের ছাপ অনেকটাই পাওয়া যায়।
প্রথম ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত নজরুলের কবিতার নাম মুক্তি, ১৩২৬ বাংলা সনে, ইং ১৯১৯ ছাপা হয় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় শ্রাবণ সংখ্যায়।
সেই বছরই তখনকার অভিজাত পত্রিকা প্রবাসীর পৌষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় হাফেজ এর একটি রুবাইয়াৎ -এর অনুবাদ। একই বছরে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় ছাপা হয় ব্যথার দান ও হেনা গল্প।
এই প্রেমের গল্প দুটিতে নজরুলের দেশপ্রেম ও আন্তর্জাতিকতা বোণের পরিচয় পাওয়া যায়।
১৯১৯ খ্রিঃ মার্চ -এপ্রিলে ৪৯ নং বাঙালী পল্টন ভেঙ্গে দেওয়া হলে নজরুল কলিকাতায় আসেন। নতুন বেগ সঞ্চারিত হয় নজরুলের কাব্যচর্চায়।
বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে নজরুলের কবিখ্যাতি দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল। বিদ্রোহী কবি রূপে তিনি স্বতঃস্ফুর্ত অভিনন্দন লাভ করেন দেশবাসীর কাছে।
মে ভুখা হুঁ শীর্ষক প্রবন্ধ ধূমকেতু পত্রিকায় প্রকাশের পর ১৯২৩ খ্রিঃ ১৬ ই জানুয়ারী রাজদ্রোহের অভিযোগে নজরুলের একবছর সশ্রম কারাদন্ড হয়। ১৯২৩ খ্রিঃ অক্টোবর মাসে নজরুলের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়।
এই গ্রন্থের প্রচ্ছদপট এঁকেছিলেন শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কারাবাসকালে জেল কর্তৃপক্ষের নির্মম আচরণের প্রতিবাদে বিদ্রোহী নজরুল হুগলী জেলে অনশন শুরু করেন। এই সময়ে বিখ্যাত গান ‘ এই শিকলপরা ছল সহ
ভাঙ্গার গান, সেবক, মরণবরণ গানগুলি রচনা করে গলাছেড়ে গেয়ে বন্দিদের প্রাণে আগুন জ্বালিয়ে দিতেন।
নজরুলের অনশনের সংবাদে দেশের সর্বত্র ইংরাজ সরকারের বিরুদ্ধে জনরোষ ছড়িয়ে পড়ে। শিলং থেকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তার করলেন, “Give up hunger strike, our literature claims you.”। জেলের কর্তৃপক্ষ সেই তারবার্তা নজরুলের হাতে দেন নি। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র, আবদুল্লা সুরাবর্দী প্রমুখ দেশমান্য ব্যক্তিদের অনুরোধ বিফলে গেল। ঊনচল্লিশ দিন অনশনের পর জনমতের চাপে ও রবীন্দ্রনাথের হস্তক্ষেপে ইংরাজ সরকার বন্দিদের দাবী মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। নজরুল চল্লিশ দিনের অনশন ভঙ্গ করেন।
১৯২৪ খ্রিঃ ২৪ শে এপ্রিল, বৈশাখ, ১৩৩১ সন, নজরুল প্রমীলা সেনগুপ্তের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। সেই বছরেই প্রকাশিত হয় বিষের বাঁশী। ১৯২৫ খ্রিঃ ফরিদপুরে কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে কবির প্রথম পরিচয় ঘটে। কবির কণ্ঠে ‘চরকার গান’ শুনে গান্ধীজি মুগ্ধ হন।
নিরন্তর দুঃখ-দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করেও নজরুলের সাহিত্য সাধনা ছিল অবিরাম। একের পর এক কবিতা, গান, প্রবন্ধ রচনা করে তিনি বাংলার সাহিত্য ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন।
১৯২৬ খ্রিঃ কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। সেই সময় কবি কৃষ্ণনগরে। লিখলেন কান্ডারী হুঁশিয়ার। কৃষ্ণনগরে কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে এই গানটি গাওয়া হয়। দেশবন্ধুর স্বরাজ পার্টির সম্মেলনে ওই সময়েই লিখে কবি গাইলেন ‘ওঠরে চাষী জগৎবাসী ধর কসে লাঙল’।
বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে বিদ্রোহী কবি নজরুলের আবির্ভাব। কবিতায়, গানে, প্রবন্ধে, নিজের উদার জীবনচর্যায়, নির্ভীকতা ও ন্যায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামের উজ্জ্বল প্রতীকরূপে জাতির জীবনে নিজেকে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন।
কাজী নজরুল ইসলাম এর পুরস্কার ও সম্মান: Kazi Nazrul Islam’s Awards And Honors
১৯৪৫ খ্রিঃ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নজরুলকে জগত্তারিণী পদক পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করেন। ১৯৬০ খ্রিঃ ভারত সরকার পদ্মভূষণ উপাধি দেন।
বহুমূল্যবান রসোত্তীর্ণ কাব্যস্রষ্টা, অসংখ্য গানের রচয়িতা ও সুরকার নজরুল ইসলামের পরিচয় ব্যক্ত হয়েছে তাঁরই একটি ভাষণে। বাংলা ১৩৪৭, চৈত্রমাসে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির রজতজয়ন্তী অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে তিনি বলেন, “দুঃখ সয়েছি, আঘাতকে হাসিমুখে বরণ করেছি কিন্তু আত্মার অবমাননা করিনি। নিজের স্বাধীনতাকে কখনো বিসর্জন দিইনি। বলবীর চির উন্নত মম শির -একথা আমি আমার অনুভূতি থেকেই পেয়েছি।”
১৯২৮ খ্রিঃ নজরুল ব্রিটিশ গ্রামোফোন কোম্পানিতে কাজ পান। প্রথমে গানের ট্রেনার ও পরে তিনি কম্পোজারও হয়েছিলেন। তাঁর রচিত গানের সংখ্যা তিন হাজারেরও বেশি। তাঁর নিজস্ব সংগীত-রীতি নজরুল-গীতি নামে পরিচিত।
সবাক চলচ্চিত্রের সূচনা পর্ব থেকেই নজরুল বাংলা চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত হন। ধ্রুব, বিদ্যাপতি, সাপুড়ে প্রভৃতি ছবির সঙ্গীত রচনার সঙ্গে কাহিনীও তিনি রচনা করেছিলেন। ১৯৩৯ খ্রিঃ নজরুল-জায়া প্রমীলা পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়ে যান। কয়েক বছর পরে ১৯৪২ খ্রিঃ কবি নিজেও পক্ষাঘাতে বোধশক্তি হারিয়ে নীরব নির্বাক হয়ে যান।
১৯৫৩ খ্রিঃ চিকিৎসার জন সস্ত্রীক নজরুলকে ইউরোপ পাঠানো হয়। ১৯৭২ খ্রিঃ বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমান কবিকে বাংলাদেশে নিয়ে গিয়েও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য যে নীরব কবি আর স্বর ফিরে পাননি।
বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৫ খ্রিঃ শহীদ দিবসে নজরুলকে একুশে পদক দিয়ে সম্মানিত করেন।
কাজী নজরুল ইসলাম এর মৃত্যু: Kazi Nazrul Islam’s Death
১৯৭৬ খ্রিঃ ২৯ শে জুন চিরবিদ্রোহী নজরুল ঢাকাতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সেখানেই রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে কবরস্থ করা হয়।
আরও পড়ুন-
- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জীবনী
- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জীবনী
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনী
- মাইকেল মধুসূদন দত্ত জীবনী
কাজী নজরুল ইসলাম কি জন্য বিখ্যাত?
কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে ১৮৯৯ – ২৯ আগস্ট ১৯৭৬; ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ – ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) বিংশ শতাব্দীর প্রধান বাঙালি কবি ও সঙ্গীতকার। তার মাত্র ২৩ বৎসরের সাহিত্যিক জীবনে সৃষ্টির যে প্রাচুর্য তা তুলনারহিত। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তার প্রধান পরিচয় তিনি কবি। তার জীবন শুরু হয়েছিল অকিঞ্চিতকর পরিবেশে।
নজরুল জীবনী লেখক কে কে?
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) বস্তুনিষ্ঠ জীবনী লেখার প্রয়াস চালিয়েছেন অনেকেই। বিশিষ্ট গবেষক মোরশেদ শফিউল হাসান বর্ণাঢ্য কবিজীবনকে সব শ্রেণির পাঠকের জন্য সহজ করে, প্রামাণ্যতা অক্ষুণ্ন রেখে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন তাঁর নজরুল জীবনকথা (প্রথমা প্রকাশন, প্রথম প্রকাশ ২০১৬, ২য় মুদ্রণ, মার্চ ২০১৭) বইয়ে।