জনাস সল্ক এর জীবনী – Janus Salk Biography in Bengali

জনাস সল্ক এর জীবনী - Janus Salk Biography in Bengali
জনাস সল্ক এর জীবনী - Janus Salk Biography in Bengali

আজ আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি মহান ব্যক্তিদের জীবনী সমগ্র (জনাস সল্ক)। মহান ব্যক্তি আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা। তাঁদের জীবনের ক্ষুদ্রতম অংশগুলি আমাদের জন্য শিক্ষামূলক হতে পারে। বর্তমানে আমরা এই মহান ব্যক্তিদের ভুলতে বসেছি। যাঁরা যুগ যুগ ধরে তাদের কর্ম ও খ্যাতির মধ্য দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন এবং জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প ও সাহিত্যের জগতে এক অনন্য অবদান রেখেছেন এবং তাঁদের শ্রেষ্ঠ গুণাবলী, চরিত্র দ্বারা দেশ ও জাতির গৌরব বৃদ্ধি করেছেন। সেইসব মহান ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম বিজ্ঞানী জনাস সল্ক (Janus Salk) -এর সমগ্র জীবনী সম্পর্কে এখানে জানব।

জনাস সল্ক এর জীবনী – Janus Salk Biography in Bengali

নামজনাস সল্ক
জন্ম১৯১৪ খ্রিঃ
জন্মস্থানক্যালিফোর্নিয়া, যু্ক্তরাষ্ট্র
জাতীয়তামার্কিন
পেশাচিকিৎসা গবেষণা
মৃত্যু২৩ জুন ১৯৯৫ (বয়স ৮০)

জনাস সল্ক কে ছিলেন? Who is Janus Salk?

ভয়ঙ্কর পোলিও রোগের কথা আজ সকলেরই জানা। এই রোগের ভ্যাক্সিন নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রচার শুরু হয় ১৯৫৫ খ্রিঃ। যে মহান বিজ্ঞানীর আবিষ্কার এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে তাঁর নাম জনাস সল্ক।

পোলিও রোগের বৈজ্ঞানিক নাম পোলিও মাইয়েলাইটিস বা শিশু পক্ষাঘাত। শিশুদেরই বেশি এই রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। ভয়ঙ্কর রোগটির লক্ষণ হুবহু ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো। মাথা ধরা, সমস্ত শরীরে প্রচন্ড ব্যাথা, গা-বমি-বমি ভাব সেই সঙ্গে থাকে জ্বর।

এই ভাবে খুব অল্প দিনের মধ্যেই এই রোগের জীবাণু স্নায়ুর পেশীগুলোকে অকেজো করে ফেলে। ফল পক্ষাঘাত।

কত অমূল্য জীবন যে এই রোগের আক্রমণে অসহায় নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে তার কোন লেখাজোখা নেই। সমীক্ষায় দেখা গেছে শতকরা ৮০ জন শিশুরই এই রোগের সম্ভাবনা থাকে। সারাজীবন পঙ্গু হয়ে থেকে অশেষ দুঃখকষ্টের মধ্যে কাটাতে হয়।

জনাস সল্কের আবিষ্কার পৃথিবীর মানুষকে এই ভয়ঙ্কর রোগের আতঙ্ক থেকে রক্ষা করেছে।

জনাস সল্ক এর জন্ম: Janus Salk’s Birthday

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটান শহরে এক ইহুদি পরিবারে ১৯১৪ খ্রিঃ জন্মেছিলেন জনাস সল্ক

জনাস সল্ক এর পিতামাতা ও জন্মস্থান: Janus Salk’s Parents And Birth Place

তাঁর বাবা শহরের কাপড়কলে কাজ করতেন। রোজগার যা হত তাতে সকলের খেয়ে পরে কোন মতে দিন কেটে যেত ।

সঙ্করা ছিলেন তিন ভাই। পড়াশুনায় সকলেই চৌকস। তার মধ্যে জনাস সর্বোত্তম। সন্তানদের শিক্ষাদীক্ষার প্রতি বাবার ছিল সতর্ক নজর। ছেলেবেলা থেকেই বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন জনাস। সমবয়সী অন্য ছেলেরা যখন খেলাধুলো নিয়ে ব্যস্ত সেই সময় বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকতেন জনাস। খেলাধুলো বিশেষ পছন্দ করতেন না।

শরীরও ছিল শীর্ণ। কিন্তু মেধা ছিল অসাধারণ। একবার যা মন দিয়ে পড়তেন, তা তাঁর মনে গেঁথে যেত।

জনাস সল্ক এর শিক্ষাজীবন: Janus Salk’s Educational Life

নিউইয়র্ক শহরের টাউনসেন্ড হ্যারিস হাইস্কুলের খুব নামডাক ছিল। এই স্কুলেই পড়াশুনা করেছিলেন জনাস।

পরীক্ষায় তাঁর ফলাফল হত চমকপ্রদ। স্কুলের ছাত্র শিক্ষক সকলেরই প্রিয়পাত্র ছিলেন তিনি। স্কুলের শেষ পরীক্ষা পর্যন্ত বরাবর সবার ওপরে থাকত তাঁর রেজাল্ট। হ্যারিস স্কুল থেকে সসম্মানে স্নাতক হয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য জনাস ভর্তি হলেন সিটি কলেজে। এই কলেজে ঢোকার আগে পর্যন্ত বিজ্ঞান বিষয়ে বিশেষ মনোযোগী হয়ে উঠলেন। তাঁর বেশি ভাল লাগত চিকিৎসা বিজ্ঞান। সিটি কলেজ থেকে বেরিয়ে তিনি ভর্তি হলেন নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা বিভাগে। আর এই সময় থেকেই জীবনের পথটিও ছকা হয়ে যায়। তিনি স্থির করেন ডাক্তারি পাশ করে চিকিৎসা গবেষণাতেই আত্মনিয়োগ করবেন।

আরও পড়ুন: চিকিৎসক জীবক জীবনী

সিটি কলেজের পরীক্ষাগুলিতেও অসাধারণ ফল করতে লাগলেন তিনি। সব পরীক্ষাতেই তাঁর স্থান সবার প্রথমে। ফলে সবরকম বৃত্তিই তিনি লাভ করলেন। বৃত্তির টাকাতেই চলতে লাগল তাঁর পড়াশুনা।

মেডিকেল কলেজে পড়ার সময়েই জনাসের পরিচয় হয় ডঃ মরিস ব্রডির সঙ্গে। ডঃ ব্রডি সেই সময় পোলিও রোগ নিয়ে গবেষণা করছিলেন।

জনাস সল্ক এর কর্ম জীবন: Janus Salk’s Work Life

সেই কলেজে আরও এক যশস্বী গবেষক অধ্যাপক ছিলেন ডঃ ফ্রান্সিস।

তিনিও একই সময়ে গবেষণা করছিলেন ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগের ওপর। জনাসকে কিন্তু আকর্ষণ করল ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগের ওপরে ডঃ ফ্রান্সিসের কাজ। আশ্চর্য এই যে উত্তরকালে ইনফ্লুয়েঞ্জা নয় পোলিও রোগ নিয়ে গবেষণার ফলেই জনাস বিশ্ববিজ্ঞানের ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করেছেন।

ডঃ ফ্রান্সিসের কাছেই কাজ শিখতে লাগলেন জনাস। সমকালীন চিকিৎসা বিজ্ঞানে ইনফ্লুয়েঞ্জা বিশেষজ্ঞ হিসেবে ডঃ ফ্রান্সিস ইতিমধ্যেই বিশ্বখ্যাতি লাভ করেছিলেন।

তাঁর কাছে কাজ শিখে গবেষণার নাড়িনক্ষত্র জানা হয়ে যায় জনাসের। এই শিক্ষাই তাঁকে পরবর্তীকালে গভীরতর গবেষণায় প্রেরণা জুগিয়েছে।

সেই সময়ে ভাইরাস ঘটিত রোগের প্রতিষেধক নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিলেন।

একদল গবেষক, ভাইরাসকে মেরে তা দিয়ে রোগের প্রতিষেধক তৈরি করে রুগীর শরীরে প্রয়োগ করছিলেন। এর ফলে রুগীর দেহে কোনরূপ বিরূপ

আরও পড়ুন: মার্শাল ওয়ারেন নীরেনবার্গ জীবনী

প্রতিক্রিয়া ঘটত না। কিন্তু এই ধরনের প্রতিষেধকের মেয়াদ হত খুবই অল্প। মেয়াদ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই ভ্যাকসিন নিতে হত।

জনাস সল্ক এর চিকিৎসার গবেষনা: Jonas Salk’s Medical Research

দ্বিতীয় ভাগের গবেষকরা চিকিৎসার এই অসুবিধার দিক বিবেচনা করে জ্যান্ত ভাইরাসকেই তাঁরা প্রতিষেধক রূপে রুগীর শরীরে প্রয়োগ করতেন। এতে সুবিধা ছিল।

প্রতিষেধক প্রয়োগের ফলে রুগীর দেহে যে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হত, তা দীর্ঘস্থায়ী হত। ঘন ঘন ভ্যাকসিন নেবার দরকার হত না। কিন্তু এই পদ্ধতির একটি মারাত্মক কুফলও ছিল।

ভ্যাকসিন প্রয়োগে যদি গোলমাল হত তাহলে রোগ প্রতিরোধের বদলে শরীর রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ত। এই ভাবেই নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে সেই সময় চলছিল রোগ প্রতিরোধ শক্তির গবেষণা।

ডঃ ফ্রান্সিস ছিলেন প্রথম মতের সমর্থক। তিনি ইনফ্লুয়েঞ্জার ভাইরাস দিয়ে কালচার বানিয়ে অর্থাৎ জৈব মাধ্যমে তাদের বংশবিস্তার ঘটিয়ে সেই ভাইরাসগুলির ওপর অতি-বেগুনী রশ্মি প্রয়োগ করে মেরে ফেলতেন। পরে ওই মৃত ভাইরাসকেই প্রতিষেধক বা ভ্যাকসিন হিসাবে ব্যবহার করতেন। এই পথ ধরেই চলছিল তাঁর গবেষণা।

ইনফ্লুয়েঞ্জা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়েই অনুরূপ লক্ষণযুক্ত আরও একটি রোগের প্রতিও দৃষ্টি পড়েছিল গবেষকদের। সেটি হল পোলিও রোগ। সেই সময়ে এই ভয়াবহ রোগটির আক্রমণে লক্ষ লক্ষ শিশু শৈশবেই পঙ্গু হয়ে পড়ছিল। তাই তার প্রতিষেধক আবিষ্কারের কাজে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন কিছু বিজ্ঞানী। ডঃ ব্রাডিও ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেবার পর থেকেই পোলিও রোগের প্রতিষেধক টীকা আবিষ্কারের জন্য গবেষণায় ডুবে গিয়েছিলেন তিনি।

একই সময়ে আরও একজন চিকিৎসাবিজ্ঞানী একই বিষয় নিয়ে গবেষণা করছিলেন টেম্পল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইরোলজি বিভাগে। তাঁর নাম ডঃ জন ফিলমার। কিন্তু গবেষণার ফলাফল তাঁরা দুজনে যা লাভ করলেন তার ফল হল দুর্ভাগ্যজনক।

আরও পড়ুন: উইলিয়াম হার্ভে জীবনী

ভাইরাস দিয়ে প্রতিষেধক তৈরি করলেন দুজনেই। সেই প্রতিষেধক প্রয়োগ করা হল কয়েকজনের সুস্থ শরীরে। পরে দেখা গেল, রোগ প্রতিরোধ শক্তি গড়ে তুলবার বদলে ওই ভ্যাকসিন শরীরে পোলিও রোগ ডেকে আনল। ফল দাঁড়াল সারাজীবনের পঙ্গুত্ব।

এই ঘটনার পরে ডঃ ব্রডি ও ডঃ কিলমার আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন অকেজো হয়ে গেল। অপযশের দায় মাথায় চাপল দুজনের।

আর তাঁদের অবস্থা প্রত্যক্ষ করে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরাও হয়ে পড়লেন আতঙ্কগ্রস্ত। ডঃ ব্রডি ও ডঃ লিমারের গবেষণা নিয়ে আর মাথা ঘামাতে চাননি কেউ।

জনাস ডাঃ ফ্রান্সিসের তত্ত্বাবধানে ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগ নিয়েই গবেষণা করছিলেন। এই সময়েই জীবনে একটি ভুল করে বসলেন তিনি। ডুবে ছিলেন ল্যাবরেটরি নিয়ে, তার মধ্যে কাঁধে চাপালেন সংসারের বোঝা। তিনি বিয়ে করে বসলেন । ফলে সংসারের খরচ-খরচার বাড়তি চাপ নিয়ে বিব্রত হয়ে পড়লেন। অর্থের অভাব মেটাবার জন্য বাড়তি রোজগারের উপায় ভাবতে হল তাঁকে।

শেষপর্যন্ত বন্ধুরা পরামর্শ দিল গবেষণার কাজে সময় নষ্ট না করে অর্থ রোজগারের জন্য প্রাইভেট প্রাকটিস শুরু করতে।

জনাস কিন্তু আর্থিক অনটনের মধ্যে থেকেও বন্ধুদের পরামর্শ মেনে নিতে পারলেন না। তিনি মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলেন এবং ইনফ্লুয়েঞ্জার ভাইরাস ও প্রতিষেধক প্রস্তুতির গবেষণাতেই মেতে রইলেন। এই ভাবে কেটে গেল পাঁচটি বছর।

তারপর চলে এলেন পিটসবার্গ মেডিকেল কলেজে। সেখানে তখন সবে ভাইরাস বাহিত রোগের ওপর কাজ করার জন্য গবেষণাগার তৈরি হয়েছে। সেই গবেষণাগারেরই অধিকর্তা হলেন জনাস।

নতুন কর্মস্থলে স্বাধীনভাবে নিজের কাজ করার প্রশস্ত সুযোগ সুবিধা পাওয়া গেল। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতেও বিলম্ব করলেন না তিনি। ইনফ্লুয়েঞ্জা ছেড়ে গবেষণা শুরু করলেন পোলিও নিয়ে।

ইতিমধ্যে ইনফ্লুয়েঞ্জা নিয়ে সাত বছর কাজ করেছিলেন জনাস। কিন্তু বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর কাজের ক্ষেত্র ইনফ্লুয়েঞ্জা নয়। পোলিও নিয়েই স্বাধীনভাবে কাজ করতে হবে। এই চিন্তা থেকেই মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ ছেড়ে পিট্সবার্গে চলে এসেছিলেন।

এখানে ইতিমধ্যেই পোলিও রোগের ওপর কাজ করার জন্য একটি বিশেষ টিম তৈরি করার প্রস্তুতি চলছিল। জনাস এসে এই টিমের অধিনায়কের পদটি গ্রহণ করলেন এবং যথারীতি গবেষণায় আত্মনিয়োগ করলেন।

নিজের ঘরে বসে একের পর এক প্রতিষেধক নিয়ে গবেষণা চালিয়ে চললেন। পরীক্ষা চালাচ্ছেন গিনিপিগ আর বানরের ওপরে।

শেষ পর্যন্ত বানরের ওপরে ভাইরাসের বিভিন্ন প্রকার প্রয়োগের পরেই পেয়ে গেলেন ঈপ্সিত বস্তুর সন্ধান।

এই কাজে মার্কিন সরকারেরও অকুণ্ঠ সহযোগিতা পেয়েছিলেন জনাস।

ইনফ্লুয়েঞ্জার ভাইরাসের সঙ্গে দীর্ঘ সাত বছরের ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল জনাসের। কাজেই পোলিওর ভাইরাসদের আলাদা করে চিনে নিতে কিছুমাত্র অসুবিধা হল না তাঁর। তিনি জেনে গেলেন পোলিওর ভাইরাস হুবহু ফ্লর মতো দেখতে হলেও তার ক্রিয়াকর্ম আলাদা।

আরও পড়ুন: ইভানজেলিস্তা টরিসেলি জীবনী

এই পর্যন্ত অগ্রসর হবার পরেই জনাস হাতে পেয়ে গেলেন পোলিও গবেষণার ওপরে তিন স্বনামখ্যাত বিজ্ঞানীর সাফল্যের বিবরণ। এই তিন বিজ্ঞানী হলেন এন্ডারস, ওয়ালার এবং রবিনসন।

এই তিন বিজ্ঞানী প্রাণীর শরীরের টিস্যুতে পোলিও ভাইরাসের কালচার তৈরি করে তাদের বংশ বৃদ্ধির উপায় আবিষ্কার করেছিলেন। আর এই কালচার নিয়ে গবেষণা করে ডাঃ ডেভিড ব্রডিয়ান নামে এক গবেষক আবিষ্কার করেছিলেন পোলিও ভাইরাস তিন রকমের হয়। তিনি তাদের আলাদা করেছিলেন টাইপ-I, টাইপ-II, ও টাইপ-III নামে।

নানান পত্র পত্রিকা ঘেঁটে পোলিও নিয়ে যাঁরা ইতিপূর্বে কাজ করেছেন তাদের বিবরণ সংগ্রহ করতে লাগলেন জনাস। সেসবের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন নিজের গবেষণা ৷

এমনি করেই একসময়ে তিনি পেয়ে গেলেন একটি সংবাদ। ডঃ হোউই নামে এক গবেষক নাকি হপকিন্স গবেষণাগারে কাজ করার সময়ে পোলিও রোগের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করে ফেলেছেন। তিনি কালচার তৈরি করার জন্য পোলিও ভাইরাসের ওপরে ‘রে’ প্রয়োগ না করে করেছেন ফরম্যালডিহাইড রাসায়নিক। তার ফলে যে মৃত ভাইরাস পেয়েছেন তা দিয়েই তৈরি করেছেন ভ্যাক্সিন।

ডাঃ হোউই-এর ভ্যাকসিন পূর্বোক্ত তিন টাইপের পোলিও ভাইরাসের বিরুদ্ধেই প্রাণীর শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারে।

কিন্তু দেখা গেল ডাঃ হোউই-এর ভ্যাকসিনকে নানা কারণে যথোপযুক্ত বলে গ্রহণ করা যায় নি। তবে তাঁর এই গবেষণার ফলে পোলিও ভ্যাকসিন আবিষ্কারের কাজটি অনেকটাই অগ্রসর হয়েছে।

মার্কিন সরকার পোলিও রোগ প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলেন। সরকারের তরফ থেকে বিজ্ঞানীদের আশ্বাস দেওয়া হল, খরচের কথা না ভেবে তাঁরা যেন নিশ্চিন্তে গবেষণা করে যান।

চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা সরকারের সাহায্যের আশ্বাস পেয়ে উঠে পড়ে লাগলেন। জনাসও দিনরাত ভুলে পোলিওকে জব্দ করার উপায় খুঁজতে লাগলেন। কেবল আমেরিকাতেই নয়, সেই সময়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশও পোলিও

নিয়ে গবেষণার কাজ এগিয়ে চলেছে। তার বিবরণ প্রকাশিত হচ্ছে বিভিন্ন জার্নালে।

উপস্থিত হল ১৯৫১ খ্রিঃ ডিসেম্বর মাস। জনাস এতদিনে একটা বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন। পোলিও রোগের পেছনে রয়েছে টাইপ-I, টাইপ-II, ও টাইপ-III এই তিন ধরনের ভাইরাস ।

একটি বিষয়ে নিশ্চিত হবার পর তিনি কার্যকরী ভ্যাকসিন আবিষ্কারের কাজে মগ্ন হলেন। এমন ভ্যাকসিন তৈরি করতে হবে যা এই তিন ভাইরাসের বিরুদ্ধেই অ্যান্টিবডি তৈরি করবে কিন্তু প্রাণীর শরীরে হবে না কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া।

এর মধ্যে জানা গেল, ডাঃ সাবিন নামে বিজ্ঞানীর তত্ত্বাবধানে একদল বিজ্ঞানীর গবেষণার ফলাফল। ডাঃ সাবিন জানিয়েছেন, ভাইরাসের মৃতদেহ নিয়ে ভ্যাক্সিন তৈরির চেষ্টা নিষ্ফল। যেভাবে গুটি বসন্তের ভ্যাকসিন যেমন মৃত নয় মৃতবৎ ভাইরাস দিয়ে তৈরি হয়েছিল, পোলিও রোগের কার্যকরী ভ্যাকসিনও সেভাবেই তৈরি করতে হবে। এছাড়া অন্য পথ নেই।

জনাস সল্ক কিন্তু এই সম্ভাবনার কথা মানতে পারলেন না। তিনি জানালেন, ডাঃ সাবিনের উপদিষ্ট পথে ভ্যাকসিন তৈরি হলে তা শরীরের পক্ষে হবে খুবই মারাত্মক। পোলিও ভ্যাক্সিন তৈরি করতে হবে মৃত ভাইরাস দিয়েই।

ডাঃ ফ্রান্সিসও জনাসের মতামতকে সমর্থন জানালেন। এইভাবে চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মধ্যে গবেষণার ফলাফল নিয়ে দুটি শিবির গড়ে উঠল। এক শিবিরের মাথায় রইলেন ডাঃ সাবিন। অন্য শিবিরের নেতৃত্ব রইল জনাস সল্কের হাতে।

মৃত ভাইরাস নিয়ে পোলিও রোগের ভ্যাক্সিন তৈরির সম্ভাবনায় জনাস ছিলেন আশাবাদী। তিনি দেখেছেন, মৃত ভাইরাসের ভ্যাকসিন ব্যবহার করে ইনফ্লুয়েঞ্জার ক্ষেত্রে আশানুরূপ ফল পাওয়া গেছে। এই ভ্যাকসিন স্বল্পায়ু হলেও এতে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা থাকে না।

জনাস এই পথ ধরেই গবেষণায় ডুবে গেলেন। তিনি স্থির করলেন. পোলিও ভাইরাসের তিন রকম টাইপের এমন একটিকে বেছে নিতে হবে যার মৃতদেহ দিয়ে তৈরি ভ্যাকসিন তিনরকম ভাইরাসের বিরুদ্ধে উপযুক্ত অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারবে। যদিও সঙ্ক জানতেন সবরকম ভ্যাকসিনেই কিছু না কিছু অসুবিধা থেকেই যায়। সর্বসুবিধাযুক্ত আদর্শ ভ্যাক্সিন তৈরি করা সম্ভব নয়। সব জেনেও তিনি পরীক্ষার পর পরীক্ষা চালিয়ে ভ্যাক্সিনের গুণাগুণ যাচাই করে চলেন। ভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা প্রমাণের পরীক্ষা চালাতে থাকেন একের পর এক বানরের ওপর।

চেষ্টা ও নিষ্ঠার একাগ্রতার ফল ফলতেও দেরি হয় না। একটি কার্যকরী ভ্যাক্সিন অবিলম্বেই তৈরি করতে সক্ষম হলেন সল্ক। কিন্তু সাফল্যের পেছন পেছনই সন্দেহ জাগে মনে, ভ্যাক্সিনের নির্ধারিত গুণ মানুষের দেহেও বজায় থাকবে তো?

জনাস সল্ক এর আবিষ্কার: Discovery by Janus Salk

১৯৫৩ খ্রিঃ গোড়ার দিকে জনাস সল্কের পোলিও রোগের ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হল নিউইয়র্কের একটি দৈনিক পত্রিকায়। খবর প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই পিটসবার্গের মেডিকেল কলেজের সামনে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। দলে দলে নরনারী শিশু সন্তান কোলে নিয়ে ভিড় জমাতে লাগলেন। সকলেই চাইছেন আগাম প্রতিষেধক নিয়ে সন্তানকে ভবিষ্যতে পোলিওর সম্ভাবনা থেকে মুক্ত রাখতে।

ইতিপূর্বে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন ১৯১৮-১৯ খ্রিস্টাব্দের মতো ওই বছরেও দেশে একটা মহামারী হবার সম্ভাবনা রয়েছে। ইনফ্লুয়েঞ্জার বদলে এবারে হয়তো পোলিওই হবে সেই মহামারীর উৎস। সেকারণে পোলিও সম্পর্কে আতঙ্কে ভুগছিলেন সন্তানের পিতামাতারা।

ক্রমবর্ধমান ভিড় দেখে প্রমাদ গুণলেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তাঁদের এবং জাতীয় বৃত্তি কমিটির অনুরোধে সন্ধকে দূরদর্শনের মাধ্যমে তাঁর বক্তব্য দেশবাসীকে জানাতে হল।

অত্যন্ত কুণ্ঠার সঙ্গে তিনি জানালেন, যে তাঁর ভ্যাক্সিনটি পোলিও রোগের একটি আদর্শ প্রতিষেধক হিসাবে কার্যকরী হবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু এখনো যথেষ্ট পরিমাণ ভ্যাক্সিন তৈরি করে ওঠা সম্ভব হয়নি বলে উপস্থিত অনেক শিশুকেই ফিরে যেতে হবে। তবে তিনি এই বলে সকলকে আশ্বাস দেন যে অবিলম্বে উপযুক্ত পরিমাণ ভ্যাক্সিনের ব্যবস্থা তিনি করবেন।

সল্কের আন্তরিক আশ্বাস, বিনীত মূর্তি ও ব্যক্তিত্ব সেদিন জনগণের মনে এই বিশ্বাস এনে দিয়েছিল যে সল্ক তাঁদের পোলিও আতঙ্ক থেকে নিশ্চিত মুক্তি দিতে সক্ষম হবেন। পোলিও সম্পর্কে তাদের ভয় অনেকটাই প্রশমিত হল।

লোক কল্যাণের কাজে পোলিও ভ্যাক্সিন টিকা প্রবর্তনের আগে সল্ক পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার জন্য নিজের শরীরেই প্রথমে টিকা নিলেন। ফলাফলে সন্তুষ্ট হয়ে একই টিকা স্ত্রী ও তিন সন্তানকে দিলেন।

আরও পড়ুন: বিজ্ঞানী চরক এর জীবনী

এরপরে আর কোন সংশয় রইল না। ব্যাপকভাবে টিকাদান শুরু করলেন। তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন জাতীয় বৃত্তি ব্যবস্থাপকের কর্তা ব্যাসিল ও’ কন্নার ও অন্যান্য সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান। দেখতে দেখতে সমগ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পরে অন্যান্য দেশেও পোলিওর টিকার ব্যবহার ছড়িয়ে পড়তে লাগল।

সল্কের নতুন এই আবিষ্কারে ব্যবহারিক উপযোগিতা সম্পর্কে বিশ্বের তাবৎ চিকিৎসকদেরও নিশ্চিন্ত করল টিকাদানের প্রসারের গোড়ার দিকের একটি ঘটনা।

বিশ্ববিখ্যাত ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ও সঙ্কের প্রেরণাদাতা ও শিক্ষাগুরু ডাঃ ফ্রান্সিস ১৯৫৪ খ্রিঃ এপ্রিল মাসে নিজের উদ্যোগ নিয়ে আঠারো লক্ষ শিশুকে পোলিওর টিকা দেওয়ালেন। পোলিও এই শিশুদের একজনের কাছেও ঘেঁষতে পারল না। সল্কের আবিষ্কারের সাফল্যের এই সংবাদ রাতারাতি ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বজুড়ে উৎসাহ উদ্দীপনার ঢেউ তুলল।

এতদিন পরে মারাত্মক পোলিও রোগের একটি ভ্যাক্সিন পেয়ে বিশ্বের অসংখ্য আর্ত পিতামাতা তাঁদের শিশুর নিরাপত্তা সম্পর্কে নিরুদ্বিগ্ন হলেন।

সল্কের জীবনের এই মহৎ সাফল্য এনে দিয়েছিল তাঁর একাগ্র সাধনা ও নিঃস্বার্থ ত্যাগ। অবশ্য তাঁকে পথ দেখিয়েছিল তাঁর পূর্বসূরী প্রতিভাবান চিকিৎসাবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস, সাবিন, কিলমার, ব্রডি ও বডিয়ান প্রমুখের পোলিও ভ্যাক্সিন সংক্রান্ত গবেষণার ফলাফলগুলি।

অবশ্য বিজ্ঞানের প্রায় প্রতিটি আবিষ্কারের ক্ষেত্রেই বিজ্ঞান সাধকদের সাধনার ফলাফলের পরম্পরা ধরাবাহিক ধারায় চূড়ান্ত পরিপূর্ণতার রূপ লাভ করে। বিজ্ঞানের ইতিহাসের এটিই চিরন্তন ঐতিহ্য।

পরবর্তী পর্যায়ে সল্ক তাঁর ভ্যাক্সিনকে আরও উন্নত মানে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

জনাস সল্ক এর মৃত্যু: Janus Salk’s Death

আর্ত মানবতার পরম বন্ধু মহান চিকিৎসাবিজ্ঞানী জনাস সল্ক ১৯৪৭ খ্রিঃ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here