প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে কেশ পরিচর্যা

প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে কেশ পরিচর্যা - Hair care in a natural way
প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে কেশ পরিচর্যা - Hair care in a natural way

কেশ পরিচর্যা কেমন হওয়া দরকার এই নিয়ে আমরা সবাই কম বেশি চিন্তিত থাকি । সভ্য় সমাজে মানুষকে সামাজিক ভাবে আকর্ষণীয় দেখানোর জন্য ও আভিজাত্যের জন্য কেশ পরিচর্যা কিভাবে পরলে আকর্ষণীয় দেখায় সেটি সবারই জানা খুব প্রয়োজন । তাই আমরা এখানে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে কেশ পরিচর্যা সম্পর্কে জানবো ।

‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা’ -ঘন কালো চুলের এরচেয়ে সুন্দর উপমা হয়তো আর হয় না । তবে চুল শুধু কবির কল্পনাকেই প্রভাবিত করে নি; বরং চুলের সৌন্দর্যে যুগে যুগে সৌন্দর্যপিপাসুরা মোহাবিষ্ট হয়েছে । তাই চুলের পরিচর্যা চলে আসছে সুপ্রাচীন কাল থেকেই । সম্রাজ্ঞী ক্লিওপেট্রার চুলও ছিলো ঘন ও লম্বা । মিশরীয় সভ্যতায়ও কেশ পরিচর্যার প্রমাণ মেলে । বেণী বাঁধার রীতি মিশর থেকে গ্রিসে প্রচলিত হয় ।

রোমান নারীদের দুর্বলতা ছিলো বব চুলের প্রতি, আর বাঙালি নারীর চুলের খোঁপা- সে তো ভুবনবিখ্যাত । চুল আজানুলম্বিত হোক অথবা বব ছাঁট, বয়-কাট হোক অথবা পুষ্পিত খোঁপা- চুলের যথাযথ যত্ন না নিলে আপনার গর্বিত চুল ঝরে যাবে অকালেই । চুল পরিচর্যার প্রাথমিক পদক্ষেপ হচ্ছে শ্যাম্পু । কিন্তু বাজারে প্রচলিত অধিকাংশ রাসায়নিক শ্যাম্পু চুলের উপকারের পরিবর্তে ক্ষতিই করে বেশি ।

এ কারণে আজকাল সৌন্দর্যসচেতন নারীরা দেশি-বিদেশি রাসায়নিক শ্যাম্পুর পরিবর্তে প্রাকৃতিক শ্যাম্পু ব্যবহার করছেন । আমরা এবার প্রাকৃতিক উপায়ে চুল পরিষ্কার করার কয়েকটি প্রণালী সম্পর্কে আলোচনা করবো ।

প্রাকৃতিক উপায়ে চুল পরিষ্কার

শ্যাম্পু বা সাবান দিয়ে চুল পরিষ্কার করলে যাদের চুল পড়ে যায় বা এলার্জি হয় তারা প্রাকৃতিক উপায়ে চুল পরিষ্কার করতে পারেন । এতে চুলের ক্ষতিও হবে না এবং চুল পড়বেও অনেক কম । যারা ঘরের বাইরে বেশি যান তারা সপ্তাহে দুদিন অবশ্যই চুল পরিষ্কার করবেন । বাইরের ধুলোবালির জন্যে চুলের গোড়ার লোমকূপগুলো বন্ধ হয়ে যেতে চায় । এতে চুল বেশি পড়ে । যাদের চুল তৈলাক্ত তাদের চুলে ময়লা আটকায় বেশি ।

মানুষের মুখের ত্বকের মতো চুলেরও বিভিন্ন ধরন আছে । যেমন:

1. তৈলাক্ত চুল
2. রুক্ষ চুল
3. স্বাভাবিক চুল

তাই আপনার যে ধরনেরই চুল হোক না কেন, প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে পরিষ্কার করলে চুলের কোনো ক্ষতি হবে না । রাসায়নিক সামগ্রী ব্যবহার করলে তার অনেক বিধিনিষেধ মানতে হয়, কিন্তু প্রাকৃতিক সামগ্রীর তেমন কোনো বিধিনিষেধ নেই । এটি একটি বিরাট সুবিধা । এবার জেনে নিন কী কী উপায়ে প্রাকৃতিক শ্যাম্পু বানিয়ে আপনি মাথা পরিষ্কার করতে পারেন ।

প্রথম পদ্ধতি

উপকরণ: দুই চামচ মেথি, চারটি শুকনো আমলকি (বিচি বাদ দিয়ে), মেহেদি পাতা বাটা এক টেবিল চামচ, খুসবু করার জন্যে একটুকরো সোন্দা ও একটুকরো লেবু ।


প্রস্তুত প্রণালী: মেথি, আমলকি ও সোন্দা একত্রে ধুয়ে এককাপ পানিতে ভিজিয়ে রাখুন । মনে রাখবেন, যেদিন মাথা ধোবেন তার একদিন আগেই এগুলো ভেজাতে হবে । মেথি, আমলকি ও সোন্দা ভিজে ফুলে নরম হবে । এবার শিলপাটায় মেথি পিষে নেবেন । মেথি ভেজানো পানি ফেলবেন না । ঐ পানি একত্রে মিশিয়ে নেবেন ।

এবার একটি পাত্রে বাটা মেহেদি, মেথি, লেবুর রস একসঙ্গে চটকে নরম পেস্টের মতো করে নিন ।

এই পেস্ট চুলে তেল দেয়ার মতো বিলি কেটে চামড়ায় এবং চুলে ভালো করে লাগিয়ে দুঘণ্টা রাখবেন । কমপক্ষে একঘণ্টা রাখলেও হবে । গোসলের সময় প্রথমে মাথায় পানি ঢেলে একটু নরম হলে আস্তে আস্তে ঘষে ঘষে পানি ঝেড়ে মাথা পরিষ্কার করবেন । এ পদ্ধতিতে চুল পরিষ্কার করতে একটু ঝামেলা মনে হলেও চুলের জন্যে বিশেষ উপকারী । মেথি পিচ্ছিল বলে এতে বেশি পানি দিয়ে মাথা পরিষ্কার করতে হয় ।

তৈলাক্ত চুল হলে গোসলের শেষে একটুকরো লেবুর রস মগে একটু পানির সাথে মিশিয়ে চুলে মেখে নিতে পারেন । এতে চুল যেমন নরম হবে তেমনি চকচকও করবে এবং মিষ্টি সুগন্ধ ভেসে আসবে । রুক্ষ ও স্বাভাবিক চুলেও এ পদ্ধতি ব্যবহার করা যায় । চুলের পরিমাণ বুঝে একই অনুপাতে দ্রব্য বাড়িয়ে নিতে পারেন ।

এ পদ্ধতিতে চুল ধুলে চুলে খুশকি হয় না এবং চুলের গোড়া শক্ত হয় । যারা প্রাকৃতিক উপায়ে চুলে রং করতে চান তারা মেহেদি পাতা বাটা বেশি করে দিলে আস্তে আস্তে কিছুদিন পর লালচে আভা আসবে । মেহেদি পাতার রস চুলের গোড়া শক্ত করে ।

রিঠার সাহায্যে চুল ধোয়া

মাথার চুল পরিষ্কার করার কাজে রিঠা ফলের গুরুত্ব আজও অপরিসীম । স্যাপিনডাস প্রজাতির গাছের ফল রিঠা । রিঠা ফল দেখতে দুধরনের-বড় ও ছোট । রিঠা ফলের শাঁস সাধারণত পরিচ্ছন্নতার কাজে ব্যবহৃত হয় । এতে ১২ শতাংশ স্যাপেনিন নামক ফেনক (সাবান) রয়েছে বলে এটি মাথার চুলকে বেশ পরিষ্কার করে এবং ঝরঝরে রাখে ।

রিঠা বীজের তেল সাবান তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয় । রিঠার নির্যাসের মধ্যে অল্প অল্প তেল থাকায় এটি চুলের কিউটিক্‌লের জন্যে বেশ উপকারী ।

আরো পড়ুন- ঠোঁটের যত্ন কিভাবে নেব জানুন কৌশল গুলি

আগে যখন শ্যাম্পু ছিলো না তখন আমাদের মা-দাদীরা চুল ধোয়ার জন্যে রিঠা ব্যবহার করতেন । ফলে তাদের চুল ঘন, কালো আর লম্বা হতো । আজকাল যত রাসায়নিক সামগ্রী আমরা ব্যবহ করছি তত আমাদের চুল ঝরে পড়ছে ।

প্রস্তুত প্রণালী: কয়েকটি রিঠা ধুয়ে নিয়ে শিলপাটায় ভেঙে ভেতরের বিচি বের করে ফেলুন । এবার চুলোয় পরিষ্কার হাড়ি বসিয়ে একমগ পরিমাণ পানিতে রিঠার খোসা ছাড়িয়ে ফুটিয়ে নিন । তিন/চার মিনিট ফোটানোর পর ঠান্ডা করে হাত দিয়ে চটকে রসটাকে ভালো করে বের করে নিন । মাথাটা একটু ভিজিয়ে নেবেন; তারপর রিঠার রস দিয়ে আস্তে আস্তে মাথা ঘষতে শুরু করবেন ।

মাথা ঘষার পর বেশি পানি দিয়ে চুল ধুতে হবে । তা না হলে রিঠার রস চুলে থেকে যাবে এবং চুল একটু আঠা আঠা মনে হবে । বাজারে মনোহারি দোকানে রিঠা কিনতে পাবেন । এ ফলটি দেখতে ঘন বাদামি ও গোলাকার ।

সর্ষের খৈল

সর্ষে যে কেবলমাত্র আমাদের রান্নাবান্নায় ব্যবহৃত হয় তা নয়; রূপচর্চায়ও এর অবদান অনেক । আপনারা হয়তো বলবেন-চুল তো স্বাস্থ্যগত কারণেই ধোয়া দরকার, তার আবার রূপচর্চার সাথে সম্পর্ক কী ? হ্যাঁ, আজকাল আর চুল শুধু ধুয়েই আমরা ক্ষান্ত নই । এখন এটিকে রূপচর্চার অঙ্গ হিসেবেও দেখছি । আমরা যতই সাজগোজ করি না কেন মাথায় তেল চিটচিটে চুল দেখলেই তাকে বলি- একেবারে গেঁয়ো ।

চুল ধুয়ে আমরা দেখি চুল চিকচিক করছে কি না কিংবা সিল্কের মতো মনে হচ্ছে কি না ইত্যাদি । তারপর রয়েছে নানা ঢং- এ চুল কাটা, বাঁধা ইত্যাদি । কারণ কেশবতী নারীর রূপই আলাদা ।

এবার আসি সর্ষের কথায় । যেকোনো বয়সের বাচ্চা হোক না কেন- খাঁটি সর্ষের তেল গায়ে মাখার রেওয়াজ আছে আমাদের দেশে । কিন্তু গ্রাম-বাংলায় সর্ষে খৈল দিয়ে চুল ধোয়ার রেওয়াজ সম্পর্কে আমরা কজনই বা জানি ! হাতের কাছের সস্তা জিনিস ব্যবহার করেও আমরা চুলকে স্বাস্থ্যসম্মত রাখতে পারি । এবার জেনে নিন কীভাবে সর্ষে খৈল দিয়ে চুল পরিষ্কার করবেন ।

প্রস্তুত প্রণালী: প্রথমে কিছুটা সর্ষের খৈল একটি বাটিতে নিয়ে সারারাত ভিজিয়ে রাখুন । পরের দিন ভালো করে চটকে নিয়ে ছাঁকনি দিয়ে ভালোভাবে ছেঁকে সে পানি মাথার চুলে ভালো করে মেখে ঘণ্টা খানেক রাখুন । তারপর গোসলের সময় মাথা ঘষে ঘষে পরিষ্কার করুন । বেশি করে পানি দিয়ে পরিষ্কার করে নিন । তারপর ভালো ভাবে চুল শুকিয়ে নিন । দেখবেন চুল ঝরঝরে হয়ে বেশ ফুলে উঠেছে ।

তৈলাক্ত চুল হলে একটুকরো লেবুর রস পানিতে মিশিয়ে চুলে ঢেলে নিতে পারেন । খৈল দিয়ে চুল ধুলে চুলে খুশকি হয় না ।

মসুরের ডালের বেসন

রান্নার উপকরণ দিয়েও আপনি চুল পরিষ্কার করতে পারেন । বেসন দিয়ে যেমন শরীর পরিষ্কার করা যায়, তেমনি চুল পরিষ্কারের কাজেও এর অবদান কম নয় । আমাদের মা-দাদীরা বেসন দিয়ে চুল পরিষ্কার করতেন ।

প্রস্তুত প্রণালী: চুলের পরিমাণ বুঝে মসুর ডাল নিয়ে ধুয়ে একটি পাত্রে পরিষ্কার পানিতে ভিজিয়ে রাখুন । তারপর শিলপাটায় বেটে নিন । পানি মিশিয়ে পেস্টের মতো করে চুলে বিলি কেটে ঘণ্টাখানেক রেখে চুল ভালোভাবে পানি দিয়ে পরিষ্কার করে ফেলুন । ভালোভাবে চুল শুকালে আঁচড়ে ফেলুন ।

দেখবেন চুল ঝরঝরে হয়েছে । আপনার যদি গ্রাইন্ডিং মেশিন থাকে তবে তাতেও ডাল গুঁড়ো করে বেসন তৈরি করে নিতে পারেন । বেসনের সাথে পানি মিশিয়ে পেস্টের মতো তৈরি করে মাথায় ব্যবহার করতে পারেন ।

চুল ধোয়ার পর কন্ডিশনার হিসেবে লেবু পানি চুলে ঢেলে দিতে পারেন । এতে চুলের খুশকিও দূর হয় । যেকোনো ডালের বেসন দিয়েই চুল ধোয়া যায়, তবে মসুরের ডালের বেসনই সবচেয়ে ভালো ।

পেঁয়াজের রস

এককালে বলা হতো, ‘বউ ভালো লাজে, সালুন (তরকারি) ভালো পেঁয়াজে’ -একথা হয়তো আমরা অনেকেই জানি । এর সাথে হয়তো আমরা অনেকেই জানি না যে, পেঁয়াজের রস চুলের এক মহৌষধ । চুলের খুশকি দূর করতে পেঁয়াজের রসের জুড়ি নেই । এমনকি পেঁয়াজের রস মাথায় ঘষলে নতুন চুলও গজায় ।

প্রস্তুত প্রণালী: ছোট পেঁয়াজ কিছু পরিমাণ নিয়ে থেঁতো করে রস বের করে সম্পূর্ণ মাথায় বিলি কেটে তেল দেয়ার মতো করে ত্বকে ও চুলে রস মেখে নিন । ঘণ্টাখানেক রেখে বেশি করে পানি দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিন । দেখবেন চুল শুকালে রেশমের মতো ফুরফুরে হয়ে উঠেছে । অনেকে গন্ধের জন্যে পেঁয়াজ দিতে চান না । এক্ষেত্রে মাথা ধোয়ার শেষে পানির সাথে সুগন্ধি কিছু মিশিয়ে নিয়ে মাথায় ঢেলে নিতে পারেন । যেমন, একমগ পানিতে দুই টুকরো শরবতি লেবুর রস মিশিয়ে মাথা ধোয়ার পর সমস্ত চুল লেবু পানি দিয়ে ধুয়ে দিলে শরবতি লেবুর খুসবু আসবে ।

আর যারা কৃত্রিম উপায়ে শ্যাম্পু দিয়ে ধুতে চান তারা চুলের উপযোগী শ্যাম্পু দিয়ে ধোবেন ।

তেঁতুলের ক্বাথ

আপনার চুলের পরিমাণ অনুযায়ী তেঁতুল নিয়ে একটি বাটিতে পানির সাথে মিশিয়ে ঘন পেস্টের মতো বানিয়ে মাথায় বিলি কেটে ১০/১৫ মিনিট রেখে ভালো করে মাথা ধুয়ে নিলে দেখবেন চুল শুকানোর পরে কেমন ফুরফুরে, নরম ও সিল্কি হয়েছে ।

যাদের অন্য কিছু স্যুট করে না তারা তেঁতুল দিয়ে চুল ধুলে উপকৃত হবেন এবং চুলও ছিঁড়বে না । চুলে কন্ডিশনার হিসেবে কিছু ব্যবহার করতে হবে না ।

কেশ পরিচর্যা

খুব সাধারণ প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে চুল পরিষ্কার করার পদ্ধতি সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করেছি । চুলের প্রকার ভেদে বিভিন্ন উপাদানের প্রয়োগ সম্পর্কে আপনারা জেনেছেন । এবার কীভাবে চুলের যত্ন করতে হয় সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো ।

চুল আঁচড়ানো

চুলকে সুন্দর, উজ্জ্বল ও পরিচ্ছন্ন রাখার জন্যে প্রত্যেকের উচিত চুল আঁচড়ানো । এতে চুলে আটকে থাকা ধুলোবালি ও মরা চুল দূর হয় । চুল আঁচড়ানো বা ব্রাশ করার ফলে মাথার ত্বকে রক্ত চলাচল বেড়ে গিয়ে চুলের পুষ্টি যোগায় ।
চুল আঁচড়ানো চুলের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্যে প্রয়োজনীয় হলেও অনেকে খুব বেশি চুল আঁচড়ান । এটা ঠিক নয় ।

এতে চুল ফেটে গিয়ে ভেঙে যেতে পারে । আবার আঁচড়ানোর জন্যে ব্যবহৃত ব্রাশ বা চিরুনি খারাপ হলে চুলের ক্ষতি হতে পারে । এ জন্যে ব্রাশ বা চিরুনি কেনার সময় দেখে নেবেন এর দাঁতগুলো যেন বেশি তীক্ষ্ণ বা ধারালো না হয় । দাঁতের শেষ অংশ যেন গোলাকার বা মসৃণ হয় ।

আঁচড়ানোর নিয়ম

প্রথমে মাথার ওপর থেকে চিরুনি বা ব্রাশ বসিয়ে টেনে চুলের নিচের অংশ-যাকে আমরা আগা বলি সে পর্যন্ত নামাতে হবে । এভাবে ডান পাশ থেকে শুরু করে আঁচড়াতে আঁচড়াতে বাম পাশে যাবেন । আবার বাম পাশ থেকে ডান পাশে আসবেন । এভাবে ৭০ বার চুল আঁচড়ান । এবার সমস্ত চুল উঠিয়ে মাথা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে নিয়ে গোড়া থেকে শুরু করে আগা পর্যন্ত টেনে টেনে ব্রাশ করুন ৩০ বার । মোট একশবার ব্রাশ করুন ।

এ পদ্ধতিতে প্রতিদিন একবার আঁচড়ান । এতে চুলের ঔজ্জ্বল্য বাড়বে এবং ময়লা জমতে পারবে না । রক্ত চলাচল বেড়ে গিয়ে চুল দীর্ঘায়ু হবে । চুল ঝরবেও কম । তা ছাড়া আপনি যদি বজ্রাসনে বসে ব্রাশ করতে পারেন তবে আপনার চুল অকালে পাকবেও না এবং ঝরবেও না । এটা অতি পরিচিত পদ্ধতি ।

এ পদ্ধতিতে আপনি দুসপ্তাহের মধ্যেই ফল পাবেন । জাপানী মেয়েরা এভাবে বসেই চুল আঁচড়ায় ।

চিরুনি ও ব্রাশের যত্ন

চুলের যত্নের সাথে সাথে চিরুনি ও ব্রাশের যত্নও আপনাকে নিতে হবে । যেমন প্রতি দুদিন পর আপনি চিরুনি ও ব্রাশ পরিষ্কার করবেন-

1. গরম পানিতে ভিজিয়ে নিয়ে সাবান বা জেট পাউডার দিয়ে ব্রাশ পরিষ্কার করে পরে কয়েক ফোঁটা ডেটল বা স্যাভলন পানির সাথে মিশিয়ে ধুয়ে নেবেন ।

2. একটি পাত্রে পানি নিয়ে এক টেবিল চামচ খাবার সোডা মিশিয়ে সেই পানিতে প্রথমে চিরুনি বা ব্রাশ পরিষ্কার করে নিয়ে পরে সাবান পানিতে ধুয়ে নিতে পারেন ।

চুলকে সজীব ও সুন্দর রাখার জন্যে করণীয়

1. একদিন কিংবা দুদিন অন্তর চুলের গোড়ায় ভালো করে তেল মালিশ করবেন । মালিশ করার সময় হাতের আঙুলের ডগার মাংসপিণ্ড দিয়ে মালিশ করবেন । তাড়াহুড়ো করে মালিশ করবেন না । আস্তে আস্তে ঘষবেন যেন মাথার তালুর ওপরই ঘষাটা লাগে, চুলের ওপরে নয় । এতে চুলের গোড়ায় রক্ত সঞ্চালন বাড়বে । চুল প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাবে । তেল শুধু চুলের গোড়ায় লাগাবেন । পরে চিরুনি বা ব্রাশ দিয়ে আঁচড়ালে সব চুলে তেল মেখে যাবে ।

2. সপ্তাহে একদিন অথবা দুদিন মাথা পরিষ্কার করবেন । এছাড়া চুল অপরিষ্কার মনে হলেই ধুয়ে নেবেন ।

3. শ্যাম্পু দিয়েই পরিষ্কার করুন কিংবা প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে চুল ধোয়ার একদিন আগে মাথায় তেল মালিশ করবেন । যে তেলই হোক, তেলটা সামান্য গরম করে নেবেন । এতে খুশকিও দূর হয় এবং চুল ধোয়ার পর বেশ নরম ভাব থাকে ।

মাথায় খুব খুশকি হলে

চুল ধোয়ার আগে তেল গরম করে মাথায় মালিশ করে তারপর একটা তোয়ালে গরম পানিতে ভিজিয়ে পানি নিংড়ে মাথায় ১০ মিনিট জড়িয়ে রাখবেন । তারপর খুশকি দূর করার ওষুধ বা শ্যাম্পু দিয়ে মাথা পরিষ্কার করবেন । এছাড়া প্রাকৃতিক উপায়েও আপনি খুশকি দূর করতে পারেন । যেমন: কাঁচা পেঁয়াজের রস মাথায় ভালোভাবে দিয়ে ১০ থেকে ১৫ মিনিট রাখবেন । তারপর চুল ভালো করে পরিষ্কার করবেন ।

এভাবে কিছুদিন করার পর খুশকি দূর হবে । প্রতিদিন নিজস্ব চিরুনি বা ব্রাশ দিয়ে চুল আঁচড়াবেন । কখনো অন্যের ব্রাশ, চিরুনি ব্যবহার করবেন না ।

চায়ের লিকারের সাথে পাতি লেবুর রস

চায়ের কড়া লিকারের সাথে পাতি লেবুর কয়েক ফোঁটা রস মিশিয়ে মাথা ধোয়ার পর এই লিকার পানি দিয়ে চুল ধুয়ে নেবেন । এতে চুল পড়া কমবে এবং চুল চকচক করবে ।

শুকনো আমলকি

শুকনো আমলকি দুধে চার/পাঁচ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখবেন । নরম হলে বেটে পেস্টের মতো করে মাথায় বিলি কেটে চুলের গোড়ায় ঘষে ঘষে লাগাবেন । অন্ততপক্ষে একঘণ্টা রেখে মাথা ধুয়ে ফেলবেন । আমলকির সাথে কয়েকটা মেহেদি পাতা দিতে পারলে খুব ভালো । এ পদ্ধতিতে চুল খুব ভালো থাকে ।

দুর্বাঘাস ও নারকেল তেল

একমুঠো দুর্বাঘাস খাঁটি নারকেল তেলের মধ্যে সারা রাত ভিজিয়ে রাখবেন । পরের দিন এ তেল রোদে ভালোভাবে গরম করে নিয়ে মাথায় বিলি কেটে লাগালে চুল ঘন হয় । এ তেল বোতলে রেখে দিতে পারেন । তবে রোজ রোদে দিতে হবে । মাথায় দেয়ার সময় রোদে গরম করে নেবেন ।

চুলে উকুন হলে কী করবেন

উকুন চুলের জন্যে যেমন ক্ষতিকর তেমনি অস্বস্তিকর । ‘পেডিকুলসি ক্যাপিটিস’ জাতের উকুন পরাশ্রয়ী জীবাণু । উকুন একজনের মাথা থেকে অন্যের মাথায় ছড়ায় । এরা মাথার ত্বকের ওপর বাস করে । এদের ধূসর বা সাদা রঙের লিক বা ডিম চুলের গোড়া থেকে একটু দূরে চুলের গায়ে গেঁথে থাকে । এর চিকিৎসা খুবই সহজ । বাজারে আজকাল উকুননাশক সাবান ও শ্যাম্পু পাওয়া যায় । এ দিয়েও আপনি উকুন দূর করতে পারেন । এছাড়া

1. সাড়ে পাঁচ গ্রাম ডিডিটির সঙ্গে সাড়ে তিন আউন্স ট্যালকম পাউডার মিশিয়ে একটা চূর্ণ তৈরি করে রাতে শোবার আগে চুলের ওপর বেশি করে দিয়ে একটা কাপড় দিয়ে মাথা ঢেকে রাখতে হবে । পরের দিন চিরুনি দিয়ে মাথা আঁচড়াতে হবে । এভাবে দু-তিন দিন ওষুধ প্রয়োগ করলে উকুন মরে যাবে ।

2. নারকেল তেলের সাথে ন্যাপথালিন গুঁড়ো করে মিশিয়ে চুলে লাগিয়ে ঘণ্টাখানেক রেখে দেবেন । তারপর মাথা ধুয়ে ফেলবেন । এভাবে কয়েক দিন লাগানোর পর উকুন মরে যাবে ।

3. প্রাকৃতিক উপায়েও উকুন দূর করা যায় । তুলসী পাতার রস উকুন নিধনে উপকারী । এর রস মাথায় বিলি কেটে দিয়ে ঘণ্টাখানেক রাখবেন । পরে মাথা ধুয়ে ফেলবেন ।

4. ধুতরা পাতার রস, পানের রস ও কর্পূর একসঙ্গে মিশিয়ে মাথায় লাগালে উকুন মরে যায় । এরপর মাথা ভালোভাবে ধুয়ে ফেলবেন ।

চুলের ডগা ফেটে গেলে কী করবেন

চুলের ডগা ফেটে গেলে মনে করবেন চুলের সর্বনাশ হয়েছে । কাজেই ডগা ফাটলে ডগা ছেঁটে ফেলবেন । এছাড়া কোনো উপায় নেই । তা না হলে চুল আর বাড়বে না । ধৈর্য ধরে চুল ব্রাশ করবেন । নিয়মিত খাবারের মধ্যে ভিটামিন ‘সি’ জাতীয় খাবার রাখবেন । তাহলে উপকার পাবেন । নিয়মিত তেল মালিশ করবেন । সপ্তাহে দুদিন চুল ধোবেন । খাবারের মধ্যে ‘এ’ জাতীয় ভিটামিন রাখবেন । তা হলে চুল ও ত্বক উভয়ই সুন্দর হবে ।

গাজরে প্রচুর ‘এ’ ভিটামিন পাওয়া যায় । আমড়া, আমলকি, লেবু, পেয়ারায় প্রচুর ‘সি’ ভিটামিন পাওয়া যায় । মৌসুমের সময় এগুলো খেলে উপকার পাবেন । সন্তান প্রসবের পরও অনেক মায়ের চুল পড়ে যায় । ক্যালসিয়াম ও আয়রনের হলে এটা হয়ে থাকে । তখন ডাক্তার দেখিয়ে পরামর্শ নিতে পারেন । মনে রাখবেন চুল নারীর সৌন্দর্যের এক অপরিহার্য অঙ্গ । একে অবহেলা করা উচিত নয় ।

সব ধরনের চুলের যত্নে করণীয়

1. সবসময় চিরুনি, ব্রাশ পরিষ্কার রাখবেন ।

2. খুব ঘন ঘন চুল ছাঁটবেন না । অন্ততপক্ষে একমাস বা দেড় মাস অন্তর ছাঁটবেন ।

3. চুলের আগা ফাটলে ছেঁটে ফেলবেন ।

4. চুল খুব শক্ত কিংবা টান টান করে বাঁধবেন না ।

5. চুলে রাসায়নিক দ্রব্য পারতপক্ষে ব্যবহার করবেন না ।

6. অন্ততপক্ষে সপ্তাহে দুদিন চুলে তেল মালিশ করবেন ।

7. অতিরিক্ত সূর্যের আলো চুলের জন্যে খারাপ । তাই এর হাত থেকে চুলকে রক্ষা করবেন ।

8. বাইরে থেকে এসে চুল ব্রাশ করবেন যাতে চুলে ধুলোবালি জমতে না পারে ।

9. খাবারের সাথে ভিটামিন ‘এ’, ভিটামিন ‘সি’, ভিটামিন ‘বি’ কমপ্লেক্স ও প্রোটিন রাখবেন । এতে চুলের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে এবং চুল অকালে পাকবে না।

10. ছোট মাছ খাবেন।

11. সর্বোপরি জাজেন বা বজ্রাসনে বসে ছোট বেলা থেকে প্রতিদিন ১০০ বার চুল ব্রাশ করলে চুল অকালে পাকবে না । চুলে খুশকি হবে না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here