আচারব্যবহার ও সুন্দরভাবে কথা বলার কৌশল

আচারব্যবহার ও সুন্দরভাবে কথা বলার কৌশল
আচারব্যবহার ও সুন্দরভাবে কথা বলার কৌশল

আচারব্যবহার ও সুন্দরভাবে কথা বলার কৌশল নিয়ে আমরা সবাই কম বেশি চিন্তিত থাকি । মানুষকে সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আচারব্যবহার ও সুন্দরভাবে কথা বলার কৌশল সবারই জানা টা খুব প্রয়োজন । পরিবারে পিতার যেমন একটি অবস্থান রয়েছে তেমনি রয়েছে মায়ের ও ছেলে-মেয়েদের, তাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে পারিবারিক আলাদা ও ভিন্ন ধরনের দায়িত্ব ও ভূমিকা, যা তাদের সামাজিক দায়িত্ব ও ভূমিকার সাথে মিলে না। তাই আমরা এখানে আচারব্যবহার ও সুন্দরভাবে কথা বলার কৌশল সেই সম্পর্কে জানাবো । যেমন- আচারব্যবহার, কথাবার্তা, দাঁড়ানো, বসা, হাঁটাচলার ভঙ্গি, সুন্দরভাবে কথা বলা, ব্যক্তিত্ব, শিষ্টাচার ইত্যাদি ।

আচারব্যবহার ও সুন্দরভাবে কথা বলার কৌশল

আচারব্যবহার

একজন মানুষের মধ্যে তার আচারব্যবহার সম্বন্ধে প্রাথমিক জ্ঞান তৈরি হয় ছোট বয়স থেকেই । অন্যের প্রতি কী ধরনের ব্যবহার করা উচিত সে সম্পর্কে প্রাথমিক শিক্ষা পায় সে তার পরিবার থেকে । তাই আপনাকে আপনার পরিবারে মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে ও কাজের লোক বা গৃহকর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, নম্র, বিনয়ী, বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করতে হবে, তেমনি পরিচিত, অন্তরঙ্গদের সাথে, প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনদের সাথেও স্বাভাবিক সুন্দর ব্যবহার করতে হবে ।

আপনি যদি পরিবারের সবার সাথে ভালো ব্যবহারে অভ্যস্ত না হন তবে পরিবারের বাইরে যে বিশাল জগৎ রয়েছে সেখানে কখনো ভালো ব্যবহার করতে পারবেন না । আর আপনার আচরণের ওপর নির্ভর করবে আপনি বা আপনার সঙ্গ অন্যের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য বা আকর্ষণীয় । মনে রাখবেন, আপনি যেরকম আচরণ করবেন অন্যের কাছ থেকেও তেমনি আচরণ পাবেন । হয়তো যার সাথে ভালো আচরণ করেছেন সে আপনার সাথে সেরকম আচরণ না-ও করতে পারে । কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে তা অন্য জায়গা থেকে আপনি পাবেন । কোয়ান্টাম মেথডে একে বলা হয় “Laws of Natural Return” |

কখনো কখনো আমরা শুনে থাকি-আরে, অমুকের মতো লোক হয় না, অমুক মহিলার ব্যবহারের তুলনা হয় না । আসলে এটা তেমন কোনো কঠিন কাজ নয় । আপনিও ইচ্ছে করলে তা পারবেন । আসল কথা, যেকোনো পরিস্থিতিতে প্রো-একটিভ থেকে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা যার মধ্যে বেশি সে-ই এ গুণের অধিকারী হতে পারে । একটু চেষ্টা করলে আপনিও ধীরে ধীরে এ গুণের অধিকারিণী হতে পারেন ।

আরো পড়ুন- পারিবারিক দায়িত্ব নিতে জানুন আপনার কি কি করণীয়

বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক সমাজে আছে হতাশা, ব্যর্থতা, দুঃখযন্ত্রণা । আপনাকে পরিস্থিতি সামলে নিয়ে শোকরগোজার থাকতে হবে । হতাশ হয়ে, অস্থির হয়ে দুর্ব্যবহার করলে কেউ আপনাকে ভালো দৃষ্টিতে দেখবে না । ক্রমান্বয়ে কাছের মানুষগুলোও আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যাবে । কাজেই পরিস্থিতি যা-ই হোক, তাকে সামলে নিয়ে মনকে প্রশান্ত রেখে মিষ্টি ব্যবহার দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে ।

আচারব্যবহারের সাথে আপনাকে অবশ্যই আত্মমর্যাদার দিকে নজর রাখতে হবে । আত্মমর্যাদা বজায় রেখেই আপনি অন্যের সাথে সে রকম ব্যবহার করবেন । পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের সাথে ব্যবহারে অবশ্যই সৌজন্যবোধ ও সহৃদয়তার পরিচয় রাখতে হবে ।

অহংকার থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারলে সবার কাছে আপনি হয়ে উঠবেন আকর্ষণীয় । পরশ্রীকাতরতা, ঈর্ষাপরায়ণতা যদি আপনার মধ্যে থাকে সেগুলোকে দূর করতে হবে । আত্মমর্যাদা বজায় রাখতে গিয়ে যেন দাম্ভিক না হয়ে ওঠেন সেদিকে খেয়াল রাখুন । যথাসম্ভব বিনয়ী হোন । তাহলেই আপনি যেকোনো পরিবেশে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হতে পারবেন ।

কথাবার্তা

কথাবার্তায় যতটা সম্ভব সত্য বলতে চেষ্টা করবেন । বললেন এক, করলেন আরেক ।

কাউকে কথা দিয়ে কথা রাখলেন না আবার এমন একটা কথা বলে ফেললেন যেটা অন্যের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ালো, অথচ আপনি না বললেও পারতেন । তাই কথাবার্তায় সবসময় সংযমী হতে হবে । অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কখনো কখনো সত্য বলতে না পারলেও অহেতুক মিথ্যা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে ।

একবার যদি আপনার সম্পর্কে মানুষের এমন ধারণা হয় যে, আপনি যা বলেন তা প্রায়ই মিথ্যা, তাহলে আপনার সত্য কথাকেও মানুষ মিথ্যা ভাববে । আপনার সম্বন্ধে খারাপ ধারণা পোষণ করবে ।

দাঁড়ানো, বসা, হাঁটাচলার ভঙ্গি

দাঁড়ানো, বসা বা হাঁটাচলার ভঙ্গি দেহ সৌন্দর্যকে অনেকখানি আকর্ষণীয় করে তোলে । দাঁড়ানো, হাঁটাচলা, বসার ভঙ্গি হওয়া উচিত ঋজু অর্থাৎ কাঁধ সোজা রেখে ঘাড় উঁচু করে টানটান ভঙ্গিতে দাঁড়াবেন ।

হাঁটাচলা করবেন দৃষ্টি সামনে রেখে । যার সাথে কথা বলবেন দৃষ্টি তার বরাবর রাখবেন । বাঁকা হয়ে, ঝুঁকে, কুঁজো হয়ে দাঁড়ালে হাঁটলে চললে বা বসলে আপনার স্বাভাবিক সৌন্দর্য কমে যাবে ।

শালীনতা বজায় রেখে শোভন ভঙ্গিতে বসবেন । চেয়ারে বসলে সোজা ভঙ্গিতে বসবেন । কখনো পা দোলাতে থাকবেন না । এটি অশিষ্টাচার । এ ধরনের অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে । বহুক্ষণ বসে থাকতে হলে পা পাল্টে বসুন । মাটিতে বসতে হলে দুই পা মুড়ে আরামদায়ক ভঙ্গিতে বসুন, কিন্তু খেয়াল রাখবেন আপনার পা যেন শাড়ি দিয়ে ঢাকা থাকে ।

তা না হলে দৃষ্টিকটু লাগবে । অর্থাৎ আপনার বসার ভঙ্গি এমন হবে যাতে আপনার মাঝে শালীনতাবোধের পরিচয় ফুটে ওঠে ।

সুন্দরভাবে কথা বলুন

সুন্দরভাবে কথা বলা একটি বিশেষ গুণ । সুন্দর কথা দিয়ে জয় করতে পারেন অনেকের মন । কখনো কারো সাথে আলাপ করলে আপনি অবশ্যই তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবেন ।

কিছুতেই যেন সে না ভাবে আপনি তাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না । তাই অন্যের কথা মন দিয়ে শোনার ধৈর্য আপনাকে রপ্ত করতে হবে । মানুষ সহজাত ভাবেই চায় তার কথা সকলে শুনুক । কথার মধ্যে কথা বলে ওঠা বিরক্তিকর । তাই একজনের কথা শেষ হতে দিন, তারপর আপনার কথা বলুন । সবসময় গুছিয়ে কথা বলুন ।

একজন বললো এক, আপনি বুঝলেন আরেক -এরকম করবেন না । কথার প্রসঙ্গ যা, তার বাইরে বলার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে ।

আরো পড়ুন- পারিবারিক শিষ্টাচার গুলি যা মানুষকে সুখী ও পরিতৃপ্ত করে

কখনো কাউকে সরাসরি অপমানজনক কথা বলে আহত করবেন না । প্রয়োজনে পরে তার সাথে আলাপ করে শুধরে দিতে পারেন । কারো কথায় ভুল থাকলে তাকে আক্রমণ না করে তার বিষয়ের ভুল অংশ তুলে ধরে এমনভাবে বলুন যাতে অন্যেরা বিষয়টি বুঝতে পারে । অহেতুক উত্তেজনা যেন না বাড়ে । সবসময় মার্জিতভাবে নিজের মত প্রকাশ করুন ।

কথা বলার সময় এক কথা বার বার উচ্চারণ করবেন না । এটি শ্রুতিকটু লাগবে । কথার মাঝখানে প্রয়োজনে উঠতে হলে নম্র ও বিনয়ের সাথে অনুমতি নিয়ে স্থান ত্যাগ করুন । সবিনয়ে বলুন, আমার একটু জরুরি প্রয়োজন ছিলো আমাকে এখন যেতে হয়, যদি অনুমতি দেন আসতে পারি ।

অনেকেই কথার মধ্যে শব্দ করে, এটাও ঠিক নয় । কেউ কেউ নাক টানেন । এগুলো ত্যাগ করতে হবে । কথার মাঝে হাসির প্রসঙ্গ এসে গেলে স্থান-কাল বিচার করে হাসির বহিঃপ্রকাশ করুন । ঘরোয়া পরিবেশে প্রাণ খুলে হাসুন । সামাজিক অনুষ্ঠানে সংযত থেকে হালকা হাসুন । হাসিঠাট্টা, রসিকতা- সব কিছুই উপভোগ করবেন, তবে এমন করবেন না যেন অশোভন লাগে ।

মানবিক গুণাবলি

মানবিক গুণাবলির দিকটিও আপনাকে অর্জন করতে হবে । মানুষের জন্যে ভালবাসা সার্বজনীন হওয়া চাই । আত্মকেন্দ্রিক বা শুধু স্বজনদের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখবেন না ।

কেউ যদি ভাবে আপনি নিজের ও স্বজনদের ছাড়া কিছুই ভাবেন না অর্থাৎ এক কথায় স্বার্থপর -এমন হলে চলবে না । মানুষ হিসেবে স্রষ্টা আপনাকে পাঠিয়েছেন এ পৃথিবীতে মহান কিছু করার জন্যে । সেটা নিজের জন্যে যেরকম, তেমনি অন্যের জন্যেও ।

শিষ্টাচার

মানবীয় গুণাবলির মধ্যে একটি প্রধান গুণ হলো শিষ্টাচার, যা একজনের ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তোলে । সমাজের নানান অনুকূল ও প্রতিকূল পরিবেশের শিকার আপনি হতেই পারেন । এতে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই । একটু বুদ্ধি খাটালেই পরিস্থিতি যেমনই হোক আপনি সামলে নিতে পারবেন ।

দেখা গেল বাইরে গেছেন, কেউ অশালীন ইঙ্গিত করলো, কেউ আগ বাড়িয়ে অযথা আলাপ করতে এলো -এ ক্ষেত্রে বিষয়টি নিয়ে রাগারাগি না করে না-শোনার বা না-বোঝার ভান করে এড়িয়ে যাবেন । এরকম বিরক্তিকর পরিস্থিতিতে আপনাকে সাধারণ শিষ্টাচার প্রকাশ করার দায়িত্ব পালন করতে হবে । যাতে সেখানে উপস্থিত আর পাঁচজনকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে না হয় ।

দৈনন্দিন জীবনেও আপনাকে সাধারণ শিষ্টাচার ও সৌজন্য প্রকাশে সচেতন হতে হবে । কর্মস্থলে বা ঘরে কিছু মেহমান নিয়ে হঠাৎ একজন এলে আপনার উচিত হবে নিজে অপরিচিতদের সাথে পরিচিত হওয়া যাতে তারা অস্বস্তি বোধ না করেন । আবার কোথাও হোটেল রেস্তোরাঁ বা কোনো অনুষ্ঠানে খাবার সময় কখনোই ‘ফুরুত ফুরুত’ শব্দ করে তরল জিনিস খাবেন না কিংবা অযথা ছুরি, কাঁটা চামচ দিয়ে টুকটাক শব্দ করবেন না । খাবার সময় মুখে ভঙ্গিমা করার অভ্যাস থাকলে পরিহার করবেন । এগুলো আদব বা শিষ্টাচারের পরিপন্থী ।

আসলে শিষ্টাচার আপনার স্বাভাবিক সৌন্দর্য বিকশিত করবে । কারো সাথে দেখা হলে বা কেউ আপনার বাড়িতে এলে আগে তাকে সালাম দিন । শুভেচ্ছা বিনিময় করুন । তার পরিবারের কুশলাদি জিজ্ঞেস করুন । অনুষ্ঠানে যদি দাওয়াত করে থাকেন তাহলে জিজ্ঞেস করুন কোনো রকম অসুবিধে হচ্ছে কি-না ইত্যাদি । আপনার মার্জিত ব্যবহার অন্যদের মাঝে আপনাকে এক মর্যাদাকর আসনে উন্নীত করবে ।

ব্যক্তিত্ব

ব্যক্তিত্ব মানব চরিত্রের গুরুত্বপূর্ণ দিক । শুধু সাজপোশাক দিয়েই তা ফুটিয়ে তোলা যায় না । এর প্রকাশ ঘটে আচার-আচরণ, কথাবার্তা ও মানবিক গুণাবলি প্রকাশের মাধ্যমে ।

যারা বয়সে ছোট তাদের সাথে যেমন হতে হবে সহজসরল, তেমনি বয়োজ্যেষ্ঠদের ক্ষেত্রে হবেন শ্রদ্ধাশীল বিনয়ী নম্র ও ভদ্র । জীবন সম্পর্কে স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে, সেই সাথে থাকতে হবে সঠিক মত প্রকাশের সৎ সাহস ।

অর্থাৎ চিন্তায় সৎ আর যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় সাহসী হতে হবে । জীবনের জন্যে প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করতে হবে । মেধার বিকাশ ঘটিয়ে নিজেকে দক্ষ মানুষে রূপান্তরিত করতে হবে । মনে রাখবেন, ব্যক্তিত্বহীন মানুষকে কেউ পছন্দ করে না । সে অন্যের করুণা পেলেও মর্যাদা পায় না ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here